স্কুল শিক্ষায় সংগীতের প্রয়োজনীয়তা
দেবাশিস মণ্ডল
১
মানুষের বুদ্ধির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সুখ ও
স্বাচ্ছন্দের প্রতি সচেষ্ট হয়েছে মানুষ। পারষ্পরিক সহযোগিতা ও বিশ্বাস অপেক্ষা
নিজেকে সুখে রাখার জন্য নিজের গণ্ডিকে সংক্ষিপ্ত করেছে। চেতনা-চৈতন্য বিশেষ কিছু
দিককে বিকশিত করলেও সবাই মিলে একসঙ্গে ভালো থাকার মানবিক প্রচেষ্টার দিকগুলিকে
পুষ্ট করেনি। মানুষের আবেগ ক্রমশঃ হারিয়ে যেতে বসেছে। শুধু নিজেকে নিয়ে সংকীর্ণ
চিন্তার গণ্ডী থেকে মুক্তির জন্য এখন ভাবতে হচ্ছে সমাজ বিজ্ঞানীদের।এখন ভাবতে
হচ্ছে একা বা ছোট পরিবারের মধ্যে নয়, আত্মীয় পরিজন, প্রতিবেশী থেকে সারা রাজ্য ও
দেশের মানুষের মধ্যে নিজেকে সমানভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মানুষের ঐকান্তিক মন ও
মানবিকতা গড়ে তোলার দিকে। একের বিপদে ও দুঃখে অন্যের সামিল হবার প্রয়োজন এখন বেশি
করে অনুভব করা দরকার। এজন্য শিক্ষার সূচনা থেকেই হৃদয়াবেগকে বৃহত্তর পরিধির মধ্যে
নিয়ে আসতে হবে। হাজার হাজার বছরের লক্ষ-কোটি মানুষের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আমাদের
নতুন সভ্যতা ও সংস্কৃতির দ্বারে উপনীত করেছে।একথা আমরা যেন নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে
তুলে ধরতে পারি। এজন্য সমাজের প্রতিটি মানুষ আমাদের আত্মীয়, সকলেই সকলের পরিজন।
পারস্পরিক বিশ্বাস ও সৌহার্দবোধকে বাড়ানোর জন্য যুক্তির
সঙ্গে আবেগকে বিকশিত করা জরুরী। সংগীত, নৃত্য ও নাটকের মধ্যে অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে
হৃদয়াবেগও সমাজচেতনার সূক্ষ্মতম দিকগুলিকে খুঁজে পাওয়া যায়। ফলে মানবিকতা ও শ্রদ্ধাবোধের
শিক্ষার জন্য বর্তমান সমাজ চারুকলা চর্চার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার
প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
শিশু যখন পায়ে
পায়ে চলতে শেখে তখনই তার ছন্দবোধের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ চোখে পড়ে। ছন্দের যে সুখ
বড়রাও তা অনুভব করে ছোট্ট শিশুর কাছ থেকে। তার চলা, বলা অনুকরণ করে। লক্ষনীয়
ছন্দে, সুরে, ঘুর্ণনে, নাটকীয়তায় শিশুরও দুর্বার আকর্ষণ। অন্যদিকে থাকে নতুনকে
চেনা ও জানার আকর্ষণও ক্রমে বাড়তে থাকে। শিক্ষায় এই দুই আকর্ষণকে উজ্জীবিত করার
প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমটি হল সহজাত আবেগ ও অনুভুতিগুলির সুসংহত বিকাশের মধ্যদিয়ে
মানবিকতাবোধের বিকাশ ঘটানো ও দ্বিতীয়টি হল জ্ঞান বিজ্ঞানের ও বিভিন্ন সামাজিক
বোধের সঙ্গে পরিচিতির মধ্যদিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য জ্ঞানের উন্মেষ ঘটানো। কিন্তু
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথমটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে দ্বিতীয়টির থেকে
প্রয়োজন মতো চর্চা ও অনুশীলন করা হচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ, মনস্তাত্বিকদের
যৌথ পরিকল্পনার পরিবর্তে অত্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে খুব উপর থেকে হঠাৎ হঠাৎ করে নতুন
নতুন ফরমান জারী করে এন সি টি ই র মতো কিছু সংস্থা। সমাজের ঘাটতি কোথায় তা চিহ্নিত
না করে পছন্দকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ দুর্ভাগ্যের জন্য আমরা কাকে দায়ী করতে পারি?
ফলে জ্ঞানের উন্মেষ হয় ঠিকই কিন্তু তা অত্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে। এই
শিক্ষার মধ্যেই থাকে অমানবিকতাবোধের যথেষ্ট উপাদান। তার বহিঃপ্রকাশও ঘটে সমাজের
চোখের সামনে। শিক্ষিত মানুষদের নির্মম কৃতকর্ম আমাদের নির্যাতিত করে। আমরা তথাকথিত
শিক্ষিত মানুষদের কাছে সাহস করে সমাজের, দশ ও দেশের প্রয়োজনের কথাটুকুও বলার সাহস
পাইনা। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার শিক্ষার মধ্যেই রয়েছে বিচ্ছিন্নতার বীজ।
পৃথিবীর ইতিহাসে শিক্ষার সুফল আমরা অনেক পেয়েছি। সভ্যতা
দ্রুত গতিতে মানুষকে উন্নতির শিখরের দিকে নিয়ে চলেছে। কন্তু এখনো তবু দুঃখ করে
বলেন ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’। তার কারন
স্বার্থপরতা, হিংসা। পৃথিবীতে যত মানুষ
অপুষ্টিতে অনাহারে মারাগেছে তার থেকে অনেক বেশি মানুষ হিংসার বলি হয়েছে।এ
ক্ষেত্রেও মানবিকতা বিচ্ছিন্ন শিক্ষাকেই হয়তো দায়ী করতে হয়। আমার ব্যক্তিগত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা এ
কথা বলে যে সংগীত ও অন্যান্য চারুকলা শিক্ষার মধ্যদিয়ে যে মানবিকতার স্ফূরণ ঘটে
তাকে চর্চার মধ্যে আনতে হবে। সরকারী ও বেসরকারী ঐকান্তিক প্রচেষ্টা তাকে নিশ্চয়
মলিন নতুন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে। এখানে সংগীত ও ছন্দ মানুষকে কতভাবে সাহায্য
করতে পারে সে সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হল।
২
সুরের নিজস্ব ভাষা আছে, ছন্দেরও ভাষা আছে। আনন্দের ছন্দ, দুঃখের
ছন্দ, অবসাদের ছন্দ, নীরবতার ছন্দ, কোলাহলের ছন্দ। ছন্দের সঙ্গে শব্দের মেলবন্ধনে হয়
সংগীত। আমাদের শরীরে
প্রতিনিয়ত হৃদয় থেকে রক্ত শ্রোত তরঙ্গ তুলে আন্দোলন সৃষ্টি করে চলেছে। দোলায়মান ছন্দে আমরা প্রতিনিয়ত ছন্দময়
হয়ে আছি। Douglas নামে একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, ছন্দ
সঙ্গীতের অত্যন্ত প্রভাবশালী দিক। তার সঙ্গে লয়েরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ‘Everything
from the cycle of our brain waves to the pumping of our heart . . . all
work in rhythms. We're a mass of cycles piled one on top of another, so we're
clearly organized both to generate and respond to rhythmic phenomena’। (Douglas 1987) [1]
হৃদ স্পন্দনের দুটি ক্রিয়া একটি সবল ও
অন্যটি দূর্বল। এই ক্রিয়ার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ভ্রুণ অবস্থা থেকেই। আমাদের কাজে কর্মে তার প্রকাশ ক্রমশঃ
বাড়তে থাকে। জীবনের সু-সংহতি যত সুদৃঢ়
হয়, ছন্দের বন্ধনও সুদৃঢ় হতে থাকে। আমাদের শারিরীক এই দুটি ক্রিয়াই গানের
ক্ষেত্রে আছে। ভারতীয় সংগীতে তা’ তাল ও ফাঁক নামে পরিচিত। Douglas বলেছেন, ‘…everything we do, from
conversation to bodily functions, is controlled by rhythm.’[2]
Clarke নামের একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছেন যে
শ্রোতাদের মনোরঞ্জনেও ছন্দের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সুর ও ছন্দ যুক্তভাবেই আমাদের মনোরঞ্জন
করলেও অনেক সময় শুধু মাত্র ছন্দ আমাদের আনন্দ দিতে পারে। বিশেষ করে ছন্দের বৈচিত্র ও লয়কারি বেশ
আনন্দ দেয় কিন্তু ছন্দ ও লয় বাদ দিয়ে শুধু সুর (সুর) আমাদের দীর্ঘ আনন্দ দিতে পারেনা। আর তা সম্ভবও নয়।[3] (Clarke 1999) Scott বলেছেন, ‘sometimes rhythm can be imposed without melody,
but the reverse cannot be done’[4]। The Psychological Effects of Music প্রবন্ধে Scott
Severance লিখেছেন, ‘Most
music is organized into beats (regular emphases occurring throughout the
whole piece or a section of it) some beats are major (strong) and some
are minor (weak). Syncopation is the holding of a note beginning
on a minor beat across a major beat. Closely related is off-beat rhythm,
where emphasis is placed on a beat that normally would not receive as much
emphasis.’[5]
ছন্দ আমাদের স্মৃতি শক্তি বাড়িয়ে দেয়।
শিশুরা প্রথম কথা বলতে শেখে ছন্দ মেলানো শব্দ দিয়ে। আম্মা, আব্বা, মাম্মা, বাব্বা, কাক্কা, দাদ্দা
ইত্যাদি শব্দ দিয়ে। একটু বড় হতে তারা ছড়া শেখে, ছন্দে ভরা কথা আর গানে তার
মন প্রাণ ভরিয়ে দেয় তার গুরুজনেরা।
প্রথম ভাষা উচ্চারিত হবার সময় থেকে সুর
ও ছন্দই ভাষা শেখার প্রথম অবলম্বন হয় বলেই ভাষা শেখাতে শিশুদেরও পটুত্ব দেখা যায়।
সুর ও ছন্দহীন ভাষা চর্চা শুরু হলে হয়তো শৈশবটাই দুর্বিসহ হয়ে উঠতো। বহুকাল ধরে
মানুষ এসব দেখে শুনে বুঝেছে। হয়তো নিজের অজান্তেই প্রাথমিক শিক্ষায় ছন্দের
ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে মানুষ। তাই তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে বহমান রয়েছে
যুগ যুগ ধরে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এইসব ব্যবস্থার বিশ্লেষণও শুরু হয়েছে বেশ
কিছুকাল। প্রতিদিন নতুন নতুন গবেষণায় যে সত্য জানা গেছে তা’হল ছন্দ মানুষের
স্মৃতি শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। ছন্দে শেখা গান কবিতা মানুষ ভুলে যায়না। ভুলে যায়না ছন্দে শেখা মন্ত্র তন্ত্রও।
সম্প্রতি এব্যাপারে অ্যান্নি মরফি পল তার ব্লগে লিখছেন, ‘The best way to remember facts might be to set them to
music. Medical students, for example, have long used rhythms and songs to help
them master vast quantities of information, and we’ve just gotten fresh
evidence of how effective this strategy can be.[6]
(Paul 2013)
লেখাপড়া শেখার শুরুতেও ছড়া, কবিতাই
প্রাধান্য পায়। ছন্দে পাঠ স্মৃতিতে সহজেই স্থান করে নেয় বলেই প্রাইমার রচয়িতারা
অনেক জটিল নীতিকথাও ছন্দের মাধ্যমে শিশুদের অন্তরে প্রবেশ করিয়ে দেবার জন্য সচেষ্ট
হন। সারা পৃথিবীতেই
একই নিয়মে শিশুদের সংগে কথা বলা, তাদের পড়ান্ তাদের সংগে গল্প করা হয়। আমাদের বাংলার
রূপকথাতেও ছন্দই প্রাধান্য পায়। আর তাই আবহমান কালধরে সেই সব গল্প শিশু থেকে
বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত সবার মনের মনিকোঠায় স্থান পেয়েছে। কেউ বোধহয় তার সুর ভুলে
যায়নি।
৩
যুগ যুগ ধরে মানুষ এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের মধ্যে
তাদের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা মুখে মুখে প্রবাহিত হয়েছে। তারমধ্যে কত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা
হারিয়ে গেছে তা আমরা জানিনা। কিন্তু মানুষই নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে
নিজেদের সম্মৃদ্ধ জ্ঞানকে ছন্দোবদ্ধ করে রেখে গেছে পরের প্রজন্মের মধ্যে। তা আর
হারিয়ে যায়নি। অ্যান্নি মরফি পল তার
ব্লগে David Rubin নামে একজন
বিজ্ঞানীর উধৃতি দিয়ে লিখেছেন, “Oral
tradition depends on human memory for their preservation. If a tradition is to
survive, it must be stored in one person’s memory and be passed on to another
person who is also capable to strong and retailing it. All this must occur over
many generations…Oral traditions must, therefore, have developed forms of
organization and strategies to decrease the changes that human memory imposes
on the more casual transmission of verbal material.’’[7]
David Rubin লিখেছেন ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে
তিনি দেখেছেন ছন্দোবদ্ধ অংশই তারা বেশিকরে স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে।
বাংলায় ছন্দে নামতা মুখস্ত করার মধ্যেও ছন্দের প্রাধান্য
বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দেখাযায় ছন্দে মুখস্ত কোন কিছুকে স্মরণ করতেও কোন বেগ পেতে বা
বেশি মাথা ঘামাতে হয়না। যেমন কবিতার প্রথম লাইন মনে পড়ে গেলে পরের লাইনগুলো আপনা-আপনিই
মনে এসে যায়। তারও বড় কারন হল ছন্দ ও সুর। লক্ষ্য করা যায় এনজাইমার রোগীদের দ্রুত
স্মৃতি ভ্রষ্ট হতে থাকে। যাকে সারিয়ে তোলার চিকিৎসা এখনো সম্ভব হয়নি। এই রোগীদের
শেখা গান তারা ভুলে যায়না। ফলে তাদের সুরের মাধ্যমে অনেক কিছুই শেখানো যেতে পারে
যা তারা সহজেই মনে রাখতে পারবে। হয়তো সুর ও ছন্দের মধ্যদিয়েই তাদের স্মৃতি শক্তি
ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। নানা ধরণের তথ্য মনে রাখার জন্য ছন্দ ও সুরকে ব্যবহার
করা একটি প্রাচীন পদ্ধতি। ভারতে বহুকাল এই পদ্ধিতি চালু রয়েছে। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, ভারতীয়
লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির বহু উপকরণ ছন্দে রচিত। এখনও লোকসংস্কৃতিতে ছন্দের প্রাধান্যই
চলে আসছে। ছড়া, গান থেকে লোককথা, লোকনাট্য এমনকি বর্ণনামূলক
কাহিনিও ছন্দে রচিত হয়। আধুনিক সাহিত্যেও
ছন্দের নানা পরীক্ষা নীরিক্ষা চলছে। অনেক ছড়া আছে যেগুলিতে ছন্দ বাদ দিলে তার অর্থ
খুঁজে পাওয়া যায়না। ‘গলদা চিংড়ি তিংড়ি মিংড়ি লম্বা দাঁড়ার করতাল পাকড়াশিদের
কাঁকড়া ডোবায় মাকড়শাদের হরতাল।’ এরকমই একটি উদাহরণ।
প্রায় বেশিরভাগ প্রানীই শব্দকে অনুভব করতে পারে। ফলে
শব্দের প্রভাব পড়ে মনের মধ্যে। কীট-পতংগ, পাখি,জন্তু-জানোয়ার
এবং মানুষ প্রায় প্রত্যেকে শব্দের পৃথক অর্থ বোঝে। ঝড়ের শব্দে সচেতন হয়। মেঘের
ডাকে বৃষ্টির পূর্বাভাষকে বুঝতে পারে। প্রায় সব প্রানীই শব্দ সৃষ্টি করে সম
গোত্রীয় প্রাণীদের কাছে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। কেই কেউ শব্দের মাধ্যমে নিজের
বীরত্ব প্রমান করার চেষ্টা করে। কখনো শব্দ উৎপাদন করে একই প্রজাতির পতঙ্গ বা
প্রাণীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের জন্য।
সব প্রানীর শিশুরা তাদের মায়ের কাছে নিজের অসুবিধার কথা
প্রকাশ করে শব্দ করে। কোন কোন প্রানীর শব্দ বেশ সুমধুর মনে হয় যেগুলিকে আমরা গান
বলি। আসলে প্রত্যেক প্রানীর স্বজাতির সৃষ্ট শব্দের অর্থ তারা বোঝে। তার
প্রতিক্রিয়াও তারা শব্দেই ব্যক্ত করে। হাজারো পতঙ্গ ও প্রানীর ভীড়ে স্বজাতির
বন্ধুটিকে শব্দের মাধ্যমেই খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়না।ছন্দোবদ্ধ সংগীত মানুষের ও
অন্যান্য প্রাণীর মস্তিস্কের কার্যকারিতার পরিবর্তন ঘটায়। কোন কোন সংগীত আমাদের
অবসাদ দূর করে। আমাদের উজ্জীবিত করে, আমাদের হাসায়, কাঁদায়, একাকীত্ব
দূর করে। (SAARMAN) তার Symposium looks at therapeutic benefits of musical rhythm প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘Rhythmic music may change brain function
and treat a range of neurological conditions, including attention deficit
disorder and depression, suggested scientists who gathered with
ethnomusicologists and musicians at Stanford's Center for Computer Research in
Music and Acoustics May 13.’[8]
৪
সারা পৃথিবীতে লোক
সমাজে তাদের পূজা, পার্বন ও উৎসবের সঙ্গে সংগীত ওতপ্রোতভাবে
জড়িত। সেখানে গান ও ছন্দের গুরুত্ব প্রচুর। খুব সহজ সরলভাবে রচিত তাদের গান ও সরল
ছন্দের গান তাদের উজ্জীবিত করে। যুগ যুগ ধরে তা চলে আসছে। সম্প্রতি গবেষণায়
দেখাগেছে,
‘Studies of rhythms and the brain have shown that a combination of rhythmic
light and sound stimulation has the greatest effect on brainwave frequency,
although sound alone can change brain activity. This helps explain the
significance of rhythmic sound in religious ceremonies.’[9]
ছন্দোবদ্ধ শব্দই শ্রুতি মধুর হয়। যাকে সংগীত বা সংগীতাংশ
বলাযায়। প্রত্যেক প্রানীকে তার আভ্যন্তরীন ছন্দই ছন্দে চালিত করে। তাই তার সব কাজই
ছন্দে চালিত হয়। তেমনি মানুষের কান্না-হাসি, কথাবলা, চিৎকার
করা সবের মধ্যেই ছন্দ থাকে। আভ্যন্তরীন ছন্দই মানুষ ও অন্যান্য প্রানীকে ছন্দের আনন্দ
উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। আর প্রানীর সব ধরনের শব্দই ছন্দোবদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়।
আর যেকোন দীর্ঘ শব্দই সাংগীতিক হয়ে ওঠে।
গান গেয়ে মাঝি দাঁড় টানে, গান
গাইতে গাইতে ধান কাটে চাষি। গানে গানেই দেহ মনের বাঁধন ছিড়ে যায়, দেশের
জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার সময়ও গানই হয়ে ওঠে মানুষের শানিত হাতিয়ার। শুধু মানুষই নয়, গানকে নিত্য সঙ্গী করে রাখে বিভিন্ন প্রানী। সব
প্রাণীর মধ্যেই ছন্দের ষ্পন্দন অনুভূত হয়। নানাভাবেই তার বহিপ্রকাশও ঘটে। যখন তা
শব্দের মধ্যদিয়ে প্রকাশিত হয় তখন তাকে আমরা গান বলি।
সাধারনতঃ প্রাণীরা দু’ভাবে শব্দ করতে
পারে, স্বরতন্ত্রী কাঁপিয়ে বা শরীরের কোন অংশকে আঘাত করে। কিছু
পতংগ আছে যারা তাদের মাথার পাশে পিঠের দুদিকে দুটি ছোট্ট ড্রামের মত অংশ থাকে।
সেগুলি পাতলা পর্দা দ্বারা ঢাকা থাকে। সেই পর্দা কাঁপিয়ে তারা শব্দ সৃষ্টি করে।
কিছু পতংগ তাদের বুকের পঞ্জরাস্থিগুলির উপর পাদিয়ে বেহালার মতো করে ঘসে শব্দ করে।
আসলে সব প্রানীর মধ্যেই একটা স্পন্দন অনুভূত হয়, তার বহিঃপ্রকাশ হয় ছন্দযুক্ত
শব্দের মধ্যেদিয়ে।সব প্রাণী নিজের আবেগ-অনুভুতির প্রকাশ ঘটাতে ও বিপদের সময়
আত্মরক্ষার জন্য শব্দ করে।
মানুষ ও অন্য কিছু প্রাণী শব্দকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে। মনের আবেগে
কিংবা অন্য কোন কারণে সেই শব্দকে পুনরুৎপাদন করতে পারে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য
প্রাণীদের সুরকে স্মৃতিতে ধরে রাখার ক্ষমতা খুবই কম। বেশিরভাগ প্রানীই সহজাতভাবে শব্দ করে।
কিছু পাখি শব্দকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে, তাদের স্মৃতি উন্নত বলেই
তারা নানা ধরণের শব্দ করে, সুরের চর্চা করে। কেউ কেউ গান শেখে, গান গায়। আর মানুষ অন্য অনেক
কিছুর মতো শব্দ ও সুরকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে। সুরকে স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য
অভ্যাস বা অনুশীলন করে, পরিশীলিত করে। চর্চার মধ্যদিয়ে ক্রমে তা আরো উন্নততর হয়ে
ওঠে। মানুষ যা দেখে, শুনে অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে তা মিলিয়ে নিয়ে শিক্ষা লাভ করে।
স্মৃতিতে তা সঞ্চয় করে রাখে। প্রয়োজন মতো তাকে ডাক পাঠায়। সে হয় স্মরণ ক্রিয়ার
মধ্যে। গিন্নিমা ডাক পাড়েন, ‘মেধো শিগগির যা, কর্তাকে ডেকে আন। ওপাড়ার
সতীশকে বল বিকেলে একবার দেখা করে যেন।’ শুধু স্মৃতিকেই পুনরুজ্জীবন
করা নয়, নিজের প্রয়োজন ও ইচ্ছা অনুযায়ী দরকারী কাজগুলোকে পরপর সাজানো এবং নির্দেশ
দেওয়ার মধ্যেও একটা সম্পর্কীবং যুক্তি রয়েছে একটি বাক্যের মধ্যেই। মেধোকে যেভাবে
নির্দেশ দেয় কর্তাকে সেভাবে নয়, সতীশকেও ভিন্ন সুরে ডাকতে বলা হয়েছে।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে উপকরণগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে এবং সেগুলিকে সামনে আনা
হয়েছে যাকে সাধারণভাবে কল্পনার প্রতিরূপ বলা বলা হয়। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা
মস্তিস্কে সঞ্চিত থাকে। তা থেকে প্রয়োজনীয় অংশ বা একাধিক অংশ নিজের মতো করে সামনে
আনা, সাজানো এবং ব্যবহার করা হয়।
কোন ঘটনা, দর্শনীয় বস্তুর প্রতিরূপ
চিত্রের মতোই স্মৃতিপটে সজ্জিত থাকে। কিন্তু সবকিছুই ছবির মতো নয়। যেমন শব্দ,গন্ধ, স্বাদ।
ব্যক্তি মানুষ এসব এক এক রকমভাবে স্মৃতিতে ধরে রাখে। শব্দ যেমন শ্রবনেন্দ্রীয়ের
সংগে সম্পর্কিত, গন্ধ ঘ্রানেন্দ্রীয়ের সঙ্গে, স্বাদ
স্বাদেন্দ্রীয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। স্মৃ্তিতেও বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের অনুভুতি ধারণ
করার পৃথক পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে। আবার তাদের একটার সঙ্গে অন্যের সম্পর্কও রয়েছে।
শব্দের প্রতিরূপ ভেসে আসে শব্দে মতো করেই। কোন কোন শব্দের সঙ্গে ভয় বিষ্ফোরণ ইত্যাদির সম্পর্ক থাকতে পারে। শব্দকে স্মরণ
করার সময় এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত কোন বিষয় বা ঘটনার ছবি ফুটে উঠলেও শব্দের তীব্রতা, তার প্রাবল্য, স্থায়িত্ব
ইত্যাদি স্মৃতিতে জেগে ওঠে।স্বরগ্রামের স্বরগুলি একটির সাপেক্ষে অন্যটিকে স্মরণ
করা হয়। যেমন ষড়জ স্বরের সাপেক্ষে সপ্টকের অন্য স্বরগুলির তীক্ষ্ণতা স্মরণে আসে।
কোন শব্দের গাম্ভীর্য, কারো বাচন ভঙ্গী, গানের সুর বিশেষ কোন কথা ঠিক
যেভাবে শোনা হয় ঠিক সেভাবেই মনে থাকে। অনেক দিন বা বছর পরেও তা স্মরণে আসতে পারে।
তা’ প্রকাশ করার সময় অনেক ক্ষেত্রে সেই সুর,সেই ভঙ্গীমা মনে এসে যায়।
আমরা যেসব শব্দ শুনি বা যেসব শব্দ আমাদের মনে সংবেদন সৃষ্টি করে তার মধ্যেও
নানা –প্রকার পার্থক্য থাকতে পারে। একই গান বিভিন্ন মানুষের মনে বিভিন্ন
প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ফলে সংবেদন ও প্রত্যক্ষ করার মধ্যে নানা পার্থক্য
থাকতে পারে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়াশুনা বা কাজের মধ্যে থাকলে বাইরের শব্দ সংবেদন
সৃষ্টি করলেও আমরা তা প্রত্যক্ষ করিনা। ফলে কোন প্রতিক্রিয়া হয়না। আবার
অভ্যাসবসতঃ একই শব্দ দিন দিন শুনতে শুনতে তার সংবেদন সৃষ্টির ক্ষমতা কমে যায়।
সাধারণভাবে চার রকম মানসিক প্রক্রিয়ার উপর স্মৃতি নির্ভর
করে। এই প্রক্রিয়াগুলি হল শিক্ষা, সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও স্মরণ (Recognition) বা প্রত্যভিজ্ঞা। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও এই চারটি স্তরেই স্মৃতিতে ধরে রাখা
এবং প্রয়োজন মতো তাকে ব্যবহার করার মতো
ঘটনা ঘটে চলে।[10]
স্মৃতিতে ইন্দ্রিয় সঞ্জাত বিষয়কে ধরে রাখা হয়। আর
কল্পনায় তাকে খুঁজে বের করা হয়, নিজের পছন্দের রঙে সাজানো হয়। স্মৃতি প্রতিরূপ ও কল্পনা
প্রতিরূপ সম্পর্কে মনোবিদ প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত বলেছেন, কোন একটি
বস্তু প্রত্যক্ষ করার পর যখন স্মরণ
ক্রিয়ার সাহায্যে তারই একটী প্রতিচ্ছবি আমাদের মানস চোখের সামনে তুলে ধরি তখন তাকে
বলা হয় স্মৃতি প্রতিরূপ (memory image)। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে উপাদান সংরহ করে
নতুনভাবে তাকে সাজিয়ে যখন একটি নতুন মানসিক চিত্র আমাদের মনের সামনেতুলে ধরি তখন
তাক বলা হয় কল্পনা প্রতিরূপ (Image of
imagination)।’ (সেনগুপ্ত ১৯৮৬) [11]
ছোটোবেলায় শোনা ঘুম পাড়ানি গান, ছড়া গান, বড়দের
স্মৃতিতেও অমলিন। তাকে আমরা নিজেরা গাইতে পারি। মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের মনে স্মরণ
বা পুণরুৎপাদন প্রক্রিয়াকে স্তরে ঘটে বলে উল্লেখ করেছেন। গান শোনা ও শেখা, তা
স্মৃতিতে সংগ্রহ করে রাখা ও যখন ইচ্ছা তখন তাকে গেয়ে প্রকাশ করা,। আবার কল্পনায় সেই গানকে কল্পনা স্তরে নতুন রূপ দেওয়া ও কন্ঠে তাকে প্রকাশ করা
খুব সহজেই হতে পারে। এপ্রসঙ্গে বলা দরকার
স্মৃতি ও কল্পনার অবস্থান খুব পাশাপাশি। কোন ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সময় অন্য ঘটনার
কথা মনে আসে আবার তার পরিণতি কী হতে পারে তা ধরা পড়ে কল্পনায়। কোন বিশেষ
সংগীতানুষ্ঠানে যাবার সময় শিল্পী ও শ্রোতা উভয়েরই কল্পনায় অনুষ্ঠানের একটা সম্ভাব্য
প্রতিরূপ ধরা পড়ে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তথ্য নিয়ে সেই কল্পনার প্রতিরূপ নির্মাণ
করে। কী ধরণের সংগীত পরিবেশিত হবে সে সম্পর্কে শ্রোতাদের একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়ে
থাকে আগে থেকেই।
স্মৃতি স্থিরভাবে অবস্থান করলেও এক্ষেত্রে কল্পনা
প্রয়োজন মতো পরিবর্তণ হতে পারে। যদিও এ সম্পর্কে উলটো মত ও রয়েছে। মনোবিজ্ঞানী Tichenar লিখেছেন, ‘Popular psychology regard the memory imagination as
subject to kaleidoscopic change. In fact, it is the memory image that varies
and the image of imagination that is stable.’[12]Tichenar
বলতে চেয়েছেন স্মৃতিতে যা ধরা পড়ে তার
সঙ্গে স্মৃতিতে সঞ্চিত পূর্বের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে মেশে যায়। ফলে স্মৃতি
পরিবর্তিত হতে পারে অন্যদিকে কল্পনায় যা ঘটে তা হল স্মৃতির উপাদানগুলিকে নিয়ে তার
প্রকাশ ঘটানো। ফলে কল্পনার নিজের পরিবর্তনের কোন সুযোগ থাকেনা। যাইহোক স্মৃতি থেকে
প্রয়োজনীয় ও সঠিক উপাদান গুলিকে খুঁজে আনা হল মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর
ছন্দ তাকে সহায়তা করে।
টিচেনারএর
বক্তব্য অনেকাংশে সত্য হলেও সর্বত্র তা খাটেনা। মানুষের স্মৃতি থেকে অনেক কিছু
হারিয়ে যায় একথা ঠিক কিন্তু এমন অনেক কিছু আছে যা স্মৃতি থেকে সহজে মুছে
যায়না। আবার অনেক কিছু অত্যন্ত
স্পষ্টভাবেই স্মরণে থাকে। আবার চর্চা বা অনুশীলনের মধ্যে দিয়েও স্মৃতি শক্তিকে
বাড়ানো সম্ভব। সংগীতের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি করে প্রযোজ্য। খুব ছোটোবেলায় শেখা গান
বৃদ্ধ বয়সেও মনে থাকতে পারে। তাই স্মৃতিতে তা পরিবর্তীত নাও হতে পারে। সংগীতকে
স্মৃতিতে ধারণ করার ক্ষেত্রে শুধু শব্দেরই ভূমিকা থাকে তা নয় শব্দ ও ছন্দ এই
দুয়েরই গুরুত্ব থাকে। ছন্দবোধ এবং ছন্দের
প্রকাশ সব প্রানীর সহজাত বিষয়। তবে চর্চার মধ্যদিয়ে এই বোধকে আরো উন্নত করা সম্ভব।
যেমন গান গাইতে গেলে অনুশীলন দরকার, বাজনা বাজাতে গেলেও নিয়মিত
চর্চা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্বর ও তাল-লয় বা ছন্দের চর্চা করা হয়ে থাকে। লক্ষ্যনীয়
বিষয় হল ছন্দবোধই সাঙ্গীতিক প্রচেষ্টাকে সফল করতে বেশি ভূমিকা পালন করে থাকে।
শব্দকে স্মৃতিতে ধরে রাখার মধ্যে অনেক জটিলতা রয়েছে।
এক্ষেত্রে ছন্দের ভূমিকা সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ। ছন্দের সাহায্যে দীর্ঘ শব্দকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককে ভাগ করে
স্মৃতিতে ধরে রাখা হয়। শৈশব থেকেই শুনতে শুনতে শব্দকে অর্থ ও যুক্তি বোধের
সাহায্যে স্মৃতিতে জমা রাখার অভ্যাস গড়ে ওঠে। কিন্তু সুরকে ধরে রাখার জন্য দরকার
হয় শব্দের নানান সূক্ষ্ম বোধ। তাও গড়ে ওঠে শোনা ও অভ্যাসের সাহায্যে। সব সুরের
পার্থক্যকে স্মৃতিতে ধরে রাখা অত্যন্ত জটিল। এজন্য উত্তম ছন্দ বোধের প্রয়োজন।
ছন্দবোধ বেশি হলে তার পক্ষে সুরকে স্মৃতিতে ধরে রাখাও সহজ হবে। আমি এ ব্যাপারে
একটি সমীক্ষা চালিয়েছি। তাতে দেখা গেছে বেশি ছন্দবোধ সম্পন্ন শিশুরা অপেক্ষাকৃত
বেশি সুরকে দ্রুত আয়ত্ব করতে পারে। আবার বেশিদিন সঠিকভাবে সে সুরকে স্মৃতিতে ধরে
রাখতেও পারে।
৫
আমি প্রায় একই বয়সের ১৫টি শিশুকে আলাদাভাবে একটি ছড়া গানের ক্যাসেট চালিয়ে
শুনিয়েছি। লক্ষ্য করা গেছে তাদের মধ্যে তিন জনের ছন্দবোধ যথেষ্ট বেশি। তারা সেই
সুরকে দ্রুত আয়ত্ব করেছে। মধ্যমমানের ছন্দবোধ প্রায় আট জনের। তাদেরও ছড়াটি শেখানো
গেছে একটু বেশি সময় ধরে শুনিয়ে। আর চার জনকে অনেক চেষ্টা করেও ভালোভাবে সেই ছড়া
শেখানো যায়নি।
এক সপ্তাহ পরে তাদেরকে সে গান গাইতে বলা হয়েছে। দেখাগেছে
প্রথম তিনজন সেই গান গেয়েছে যথেষ্ট সুরে। পরের আট জনও মোটামুটি ভালোই গেয়েছে।
কিন্তু শেষের চারজন সেই সুর মনে করতেই পারেনি।আমি এখানে দেখাতে চাইছি সংগীত
শিক্ষার সাংগীতিক স্মৃতিকে বাড়ানোর জন্য ছন্দ শিক্ষা ও চর্চার দিকটি বিশেষ গুরুত্ব
দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তা মানুষের ক্ষেত্রেও যেমন তেমনি পাখি বা অন্যান্য
প্রানীদের ক্ষেত্রেও হয়তো তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। সরল ছন্দবোধও সকলের ক্ষেত্রে এক রকম
নয়। শারিরীক ও মানসিক ক্রিয়ার সঙ্গে ছন্দবোধ গভীর ভাবে সম্পর্কিত।
মানুষের কাজের সঙ্গে শারীরবৃত্তীয় ছন্দের সম্পর্ক গড়ে
ওঠে। হাঁটতে চলতে, কথা বলতে, নানা রকম
কাজ করতে করতে ছন্দবোধের বিকাশ হয়। ছাদ পেটানো, দাঁড় টানা, ধান কাটা
ইত্যাদি কাজের সঙ্গে ছন্দের সম্পর্ক সুনিবিড়। তাই বলা হয়ে থাকে শ্রমের সূত্রে
সংগীতের বিকাশ। হয়তো শ্রমের মধ্যদিয়েই ছন্দেরও বিকাশ হয়েছে। কাজের বিভিন্ন গতি
প্রকৃতিতে সর্বদাই যে সরল ছন্দের ব্যবহার হয় তা নয়। কোথাও কোথাও মিশ্র বা জটিল
ছন্দের প্রয়োগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর এভাবেই বিভিন্ন ছন্দের বিকাশ ঘটেছে। এইসব
ছন্দের সঙ্গে শব্দ যুক্ত হয়েই সংগীতের সূচনা ও প্রাথমিক বিকাশ হয়ে থাকবে।
কাজের সূত্রেই ছন্দের বিকাশ হয়েছে। বিভিন্ন কাজে ধরণ ও
গতি প্রকৃতির সঙ্গে এক এক ধরণের ছন্দ চর্চিত হয়। যেমন দাঁড় টানার সময় কখনো ২/২, কখনো ৩/৩ আবার
কখনো ৩/২/২ ছন্দের সৃষ্টি হয়। ধান কাটার কাজে ৪/৪ ছন্দ। ধান ভানার সময় ৩/২ বা ২/২
ছন্দ। নলকূপ বসানোর সময় ৩/৩ বা ৪/৪ ছন্দ। ছাদ পেটার সময় ২/২ বা ৩/৩ ছন্দ। এইসব ছন্দ ক্রমে শরীর ও মনের মধ্যে
আরোপিত হয়। ধীরে ধীরে তা স্থায়ীভাবে স্থান পায়। পরে ঐ কাজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও
ছন্দ শিক্ষা থেকেই যায়।
ছন্দবোধও একটি মানসিক ক্রিয়া যা শারিরীক ক্রিয়ার
মধ্যদিয়ে মানসিক উৎকর্ষ সাধন করে। শুধু শুনে যে ছন্দের উৎকর্ষ সাধিত হয় তা শারিরীক
অঙ্গ সঞ্চালনের মধ্যে দিয়ে বৃদ্ধি পায়। মনোবিজ্ঞানী স্টাউট (Staut) মনে করেন, অনুশীলনের দ্বারা স্মৃতির উন্নতি সম্ভব নয়, কিন্তু
অনুশীলনের মাধ্যমে কোন একদিকে স্মরণ ক্রিয়ার উন্নতি সম্ভব। এক্ষেত্রে কাজের সূত্রে
ছন্দের শিক্ষা মনের মধ্যে প্রবেশিত হয়। সে ছন্দটিকে মনে রাখেনা। কাজটি মনে রাখে। আর কাজটির সঙ্গে ছন্দের সম্পর্ক থাকায় ছন্দটি স্বাভাবিক ভাবেই মনে এসে যায়। কিন্তু কর্ম
বিচ্ছিন্নভাবে সেই কাজের ছন্দটিকে হাতে তালি দিয়ে দেখাতে বললে সে সর্বাংশে সফল নাও
হতে পারে। অর্থাৎ সে কাজটিকে মনে রাখে কিন্তু ছন্দটিকে নয়। তবে চর্চার মধ্যদিয়ে
অল্প চেষ্টাতেই সে তা আয়ত্ব করতে পারে, কারন প্রচ্ছন্নভাবে তার
মধ্যে ছন্দবোধ রয়েছে।
বিজ্ঞানের ভাষায় সঙ্গীত হল বিভিন্ন প্রকার শব্দের
ছন্দোবদ্ধ প্রকাশ। সুর হল নির্দিষ্ট স্বরসীমার মধ্যে শব্দের ছন্দোবদ্ধ বিচরণ। তাই
সুর ও সংগীতকে বোঝা ও শিক্ষণের জন্য ছন্দবোধ ও ছন্দ চর্চা দরকার হয়ে পড়ে। কিন্তু
সুরের সাধনাকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় ছন্দের ছর্চাকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়না।
যেটা অত্যন্ত জরুরী।
Bibliography:
1. Clarke,
E. F. Rhythm and timing in music. 2nd ed. San Diego : Academic Press,
1999.
2. Douglas,
C. The beat goes on Psychology Today. 1987.
3. Paul,
Annie Murphy. Why Music is a Powerful Memory-Boosting Tool. Sikago:
Internet, 2013.
4. SAARMAN,
EMILY. Symphosium looks at therapeautic benifits of musical rhythm.
Chicago: Internet, 2006.
5. Saarman,
Emly. http://news.stanford.edu/pr/2006/pr-brainwave-053106.html. 1.
Symphosium looks at theraputic benifits of musical rhythm.
6.
Severance, Scott. The Psychological
Effects of Music. 1999.
7.
Symposium looks at therapeutic
benefits of musical rhythm. n.d.
8.
Tichenar, E. B. A Text Book of
Psychology. Washington: Eastern Psychological Association, 1993.
9. সেনগুপ্ত, প্রমোদবন্ধু. মনোবিদ্যা ও সমাজদর্শন. কলকাতা: ব্যানার্জি পাবলিশার্স, ১৯৮৬.
[3] Clarke, E. F. Rhythm and timing in music. In D. Deutsch (ed.)
1999, The psychology of music (2nd ed.) San Diego: Academic Press. p
473.
[4] Severance, Scott.
1999. The Psychological Effects of Music
http://www.scottseverance.us/music/effects_of_music.htm
[5] Severance, Scott. The
Psychological Effects of Music. http://www.scottseverance.us/music/effects_of_music.htm
[6] Murphy Paul, Annie. 2013, Why
Music is a Powerful Memory-Boosting Tool,
http://news.stanford.edu/pr/2006/pr-brainwave-053106.html,P-1
[7] Paul, Annie
Murphy. Why Music is a Powerful Memory-Boosting Tool,
http://www.businessinsider.com/how-music-boosts-memory-2013-9?IR=T P 2
[8] EMILY, SAARMAN. Saar man Symposium Looks at the Therapeutic
Benefits of Musical Rhythm.
http://news.stanford.edu/pr/2006/pr-brainwave-053106.html
[9] EMILY,
SAARMAN. Saar man Symposium Looks at the Therapeutic Benefits of Musical
Rhythm. http://news.stanford.edu/pr/2006/pr-brainwave-053106.html
[10] প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত।
মনোবিদ্যা ও সমাজ দর্শন। ব্যানার্জি পাবলিশার্স- ষষ্ঠ সংস্করণ। ১৯৮৬, কলকাতা, পৃষ্ঠা-১৪২।
[11] প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত। মনোবিদ্যা ও সমাজ দর্শন। ব্যানার্জি
পাবলিশার্স- ষষ্ঠ সংস্করণ। ১৯৮৬, কলকাতা, পৃষ্ঠা-১৪২।
[12] Titchener, E. B. A
Text Book of Psychology: Eastern Psychological Association. Washington.
Page 417.