সংক্ষিপ্তসার : বাংলাদেশের ঢাকা শহরের পাশেই শাহবাগ চত্বর (Sahabag Squire)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় অজস্র মানুষকে হত্যা, লুঠ ও ধর্ষণের
অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালে রাজনীতি নিরপেক্ষ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ক্রমে তা’ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা
বাংলাদেশে। এমনকি তা’ উত্তাল করে তুলেছিল প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গকেও। শাহবাগের আন্দোলন ক্রমে পরিণত হয়েছিল মৌলবাদ
বিরোধী আন্দোলনে। সেই আন্দোলনের ভাষা ছিল স্লোগান আর গান। দাবিছিল শত সহস্র মানুষের হত্যাকারী, ধর্ষক রাজাকার ও
তার সঙ্গীদের প্রকৃত শাস্তি হোক মৃত্যুদন্ড। তখন বিচার চলছিল আদালতে। তাতে টালবাহানা ছিল। মৌলবাদীদের চেষ্টা ছিল শাস্তি যাতে লঘু হয়। দীর্ঘদিন ধরে বিচার চেয়েছিল সাধারণ মানুষ । প্রায় চল্লিশ বছর। সাধারণের মনের ভাষাকে উপেক্ষা করে চলেছিল
রাজনৈতিক দলগুলো আর বিচার ব্যবস্থা। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পারস্পরিক মত বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে
সাধারণের মধ্যে যোগসুত্র রচিত হয়েছিল। সেই যোগাযোগের ভাষায় গান, কবিতা আর নতুন নতুন স্লোগান রচিত হত প্রতিদিন। আন্দোলনের ভাষায় জাগরনের গান উদ্বেল
করে তুলেছিল আন্দোলনকে আর শাহবাগ চত্বর গানে গানে মুখরিত হয়ে উঠত প্রতিদিন প্রতি
রাত। লক্ষ–লক্ষ মানুষের হাতে জ্বলন্ত
বাতির শিখা আর কণ্ঠে প্রতিবাদের সুর আকাশ বাতাসকে চেতনা সমৃদ্ধ করে আবেগে মাতিয়ে
দিত। শত সহস্র গান রচিত
হত। গানের ভাষা নতুন
নতুন ভাবনা ও চেতনায় উজ্জ্বল করে তুলত আন্দোলনের পথকে। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণার
গানগুলিও সজীব হয়ে উঠেছিল। ভারত থেকে কবীর সুমন কয়েকটি গান লিখে সুর করে ইন্টারনেটে
পাঠালে সেই গানগুলিও আন্দোলনের
অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। শুধু গানই সেই আন্দোলনকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছিল তা
বুঝেছিলেন শাহবাগ আন্দোলনের সকলেই।
....................................................................................................................
....................................................................................................................
ভারত ও
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সংগীতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষনের
বিরুদ্ধে বহু গান রচিত হয়েছে। এইসব গান সমাজে উদ্দীপনার জোয়ার এনেছে, দেশপ্রেমে উদ্দুদ্ধ
করেছে মানুষকে। অবহেলিত ও অত্যাচারিত মানুষের আবেগ উৎসারিত হয়েছে গানের ভাষায়। উনাবিংসা শতকে শিক্ষিত বাঙালি
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে স্বদেশ-ভাবনার স্রোত বইতে শুরু করে। দেশে মানুষের দুঃখ, দারিদ্র ও পরাধীনতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে
খুঁজতে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় স্বদেশী গান, মুক্তির গান। কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থাত বিদেশী শাসনের
নাগপাশ থেকে মুক্তি নয়, বিদেশী শোষনের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ স্বদেশের দুঃখ, দৈন্য থেকে মুক্তি, দেশীয়
শিল্প-বানিজ্যের মুক্তি, বিদেশী ভাষার কর্তৃত্ত থেকে মুক্তি, দেশবাসীর বিচ্ছিন্নতাবোধ ও সাম্প্রদায়িক অসংহতি
থেকে মুক্তি। সমকালীন সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মত দেশাত্মবোধক ও স্বদেশী গান রচনাও
কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তার ব্যাপকতা ছিল অনেক গভীর। সেখানে সামগ্রিকভাবে ক্রমশঃ প্রতিফলিত হয়েছে
মানুষের মুক্তিচিন্তা – তাই এইসব গান আরও ব্যাপক অর্থে মুক্তির গান। এই মুক্তির গানে যেমন
পরাধীনতার গ্লানির কথা, দেশের গৌরব ও শ্রীহীনতার কথা আছে তেমনি আছে অতীত ঐতিহ্যের
কথা, আত্মশক্তি বিকাশের
কথা, আত্মনির্ভরতার কথা
বা দেশকে মাতৃরূপে কল্পনায় বন্দনা।[i] (সুভাষচৌধুরী ২০০৩)
ভারতের
স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে স্বদেশী গান একাত্ম হয়ে পড়েছিল হিন্দুমেলার সময় থেকেই। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়
স্বদেশী গান আরো মুখর হয়ে ওঠে। এরপর মুক্তির গান ক্রমশঃ সর্বসাধারনের মধ্যে কল্লোলিত হয়ে
ওঠে।
বাংলাদেশের
ভাষা আন্দোলন ও মুক্তি আন্দোলনে নতুন করে স্বদেশী গান মুখরিত হয়। এইসব গান বাংলার সর্বসাধারণকে
ভিতর থেকে জাগিয়ে তোলে। সেই আন্দোলনের সুত্র ধরেই মৌলবাদের থেকে মুক্তির ডাক শোনা গেছে শাহবাগের
আন্দোলনে। শাহবাগের আন্দোলন থেকে উঠে এসেছে মানবতার স্পষ্ট বার্তা। ধর্মান্ধ হিংসার থেকে মুক্তি, উন্মত্ত দাঙ্গার আর
বিভীষিকার অবসান। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাংলাদেশে এসেছিল মুক্তির ডাক। মুক্তি হল স্বাধীনতার আন্দোলনে, আর এই আন্দোলনের
সূত্রেই সজ্জিত হল শাহবাগের সমাবেশ। নরপশু রাজাকার কাদের মোল্লার শাস্তির
দাবীতে লাখো-লাখো মানুষের কন্ঠস্বর শোনা গেল ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি। শাহবাগের আন্দোলনে সূচনা
হল ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। শাহবাগ বাংলার মানুষকে নতুন পথ দেখাল। নরপশুদের বিরুদ্ধের আন্দোলন পরিণত হল অসাম্প্রদায়িক
বাংলাদেশ গড়ে তলার আন্দোলনে। বাংলাদেশের এই আন্দোলন পথ দেখল ভারতকে। এই আন্দোলন থেকে হয়তো সারা পৃথিবীর ধর্ম-নিরপেক্ষ মানুষ নতুন পথের
সন্ধান পেয়েছে। একদিন এই পথকেই গ্রহণ করবে সব মানুষ এই বিশ্বাস রাখতে পারলে হয়তো পৃথিবী অনেক হিংসা ও হত্যা থেকে মুক্তি পাবে।
বাংলাদেশে
যে শাহবাগ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার সাথে যোগসূত্রের সন্ধান করতে গিয়ে সেখানকার ভাষা
আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনের কথা বলেছেন অনেকেই। ভাষা আন্দোলন ক্রমে মুক্তিযুদ্ধে রুপান্তরিত
হয়েছিল। আর মুক্তিযুদ্ধের
আন্দোলনের সূত্রে নরপশু রাজাকারের ফাঁসির
দাবি এবং রাজাকারের মদতদাতা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী রাজনৈতিক দল ‘জামায়াত’ শিবির কে নিষিদ্ধ
করার দাবী ওঠে। জামায়াত শিবির আসলে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। ফলে জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমে
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনে পরিণত হয়।
ভাষা
আন্দোলনের সূচনা থেকেই গানকে বলিষ্ঠ
হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে সেদেশের মানুষ। ভাষা আন্দোলনের গান ক্রমে জাতীয়তাবোধকে প্রবল
করে তোলে। জাতীয়তাবোধের আবেগ থেকেই তারা অনুভব করে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা, শুরু হয় মুক্তির
গান, মুক্তি আন্দোলন। অনেক রক্তের বিনিময়ে যে
স্বাধীনতা আসে সেই স্বাধীনতাকেও এক শ্রেণীর মানুষ হরণ করার চেষ্টা করে। সাম্প্রদায়িকতার করাল গ্রাসে অন্ধকার নামতে শুরু করে। ক্রমে উত্থান হয় জামায়াত শিবিরের এবং তাদের
মদতদাতাদের রাজনৈতিক দলের। এর বিরুদ্ধে নতুন করে গণজাগরণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার
বিরুদ্ধে আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনের চেয়ে অনেক বেশী কঠিন। কারণ, মুক্তির দাবী দেশের সব মানুষের আর ধর্মীয় মুক্তির দাবি সব
ধর্মের বর্ণের মানুষের ক্ষেত্রে একই রকম
নয়। সারা পৃথিবীতে
বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ আন্দোলন হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বর্ণ বিদ্বেষের
বিরুদ্ধে মুখর হয়েছে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার
বিরুদ্ধে সেভাবে বৃহৎ আন্দোলন দানা বাঁধেনি। বাংলাদেশে রাজাকারের ফাঁসির দাবিকে
সামনে রেখে মৌল্বাদের বিরুদ্ধে যে সতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে উতঠেছিল তা সত্যিই নজির
বিহীন।
বাহান্নর
ভাষা আন্দোলনের যে আবেগ তাতে বাংলাদেষের শিল্পী সাহিত্যিক সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
বলাযায় শিল্পী সাহিত্যিকরাই এই আন্দোলনের মূল প্রেরণা। সে সময় কত গান কত কবিতা
রচিত হয়েছে তার হিসাব নেই। সেখানে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় অসংখ্য
সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে বহু সাংস্কৃতিক কর্মী। ১৯৫১ সালের শেষভাগে ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান
শোনাযায়। গানটির রচনাকার আব্দুল লতিফ। যদিও গানটি অনেক বেশি সমাদৃত হয়েছিল ১৯৫২
সালের ফেব্রুয়ারির পরে। ১৯৫২ তেই
রচিত হয়েছিল ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলার’ গানটি। এটিও আব্দুল লতিফের রচনা। আরো অনেক গান সে সময় রচিত
হয়েছিল। সেইসব গানের ইতিহাস আজ আর জানা নেই। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে ভাষা আন্দোলন
দুর্ব্বার রূপ পায়। সরকার যতই জোর করে ঊর্দু চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে ভাষা
আন্দোলনও ততই প্রবল হয়ে ওঠে। ঢাকা শহর জুড়ে সমস্ত আন্দোলন বন্ধ করার জন্য ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ধারা জারি হয়। এর প্রতিবাদে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়।
২১ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা আইন সভায় তাদের দাবি উত্থাপন করার জন্য রওনা হয়।
সেই সময় পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে আব্দুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমেদ, আব্দুস সালাম, আব্দুল বরকত সহ আরো অনেকে নিহত হন। একজন ন’বছরের কিশোরও মারা যায়। পরের
দিন এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে বহু মানুষ সমবেত মিছিলে সামিল হলে তাদের উপর গুলি
চলে আরো চারজন শহীদ হন। ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের নানা স্থানে সাধারণ মানুষের মিছিলের
উপর গুলি চালায় পাকিস্তানী পুলিশ। বহু মানুষ নিহত হন। তাদের সবার খবর প্রচারিত
হয়নি, কিন্তু এই নৃশংসতা আপামর সাধারণ মানুষের মধ্যে
স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে জাগিয়ে তোলে এবং ভাষা আন্দোলনকে আরো বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। আন্দোলনের সঙ্গে চলে আন্দোলনের গান। আর গানই হয়ে ওঠে আন্দোলনের
অনুপ্রেরণার মন্ত্র। গানে গানে লাখো মানুষ পথ হাঁটেন, প্রতিবাদে সামিল হ’ন।
২১শে
ফেব্রুয়ারির শহীদদের স্মরণ করে অনেক গান রচিত হয়। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমিক
ভুলিতে পারি’ গানটি একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে রচিত প্রথম গান
বলে জানা যায়। গানটি রচনা করেছিলেন আব্দুল গফফর চৌধুরী। গানটিতে প্রথম সুরারোপ
করেন আব্দুল লতিফ।পরে ১৯৯৪ সালে আলতাফ মামুদ এই গানটিতে নতুন করে সুরারোপ করেন।
সেই থেকেই এই গানটি হয়ে যায় ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীর গান। তখন থেকে এই গানটি
এখন পর্যন্ত প্রতি বছর দেশে ও বিভিন্ন দেশে এই গান গেয়ে ভাষা শহীদদের স্মরণ ও
শ্রদ্ধা জানানো হয়। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের ২১শের স্মরণে লেখা গানের একটি
সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সরকার এই গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করে। কম জনপ্রিয় হলেও ভাষা
আন্দোলনের প্রথম দিকেই একটি কবিতা পরে খুব জনপ্রিয় হয়ে ছিল। সেটি হল ‘ভুলবনা ভুলবনা একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবনা’। কবিতাটি (সৈনি) সৈনিক গাজীউল হক এর লেখা। কবিতাটি পরে প্রচলিত
সিনেমার গানের সুরে গাওয়া হত।
ভাষা
আন্দোলনের প্রথম গান সম্পর্কে কিছু মত পার্থক্য রয়েছে। কোন কোন গবেষক জানিয়েছেন
ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান রচনা করেন মোসারফ উদ্দীন আহমেদ। গানটি হল ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা
বাঁচাবার তরে।/ আজকে স্মরিও তারে’। গানটি ১৯৫২ সালের ২৪শে
ফব্রুয়ারি মোসারফ উদ্দীন আহমেদ রচনা করেন।
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংপৃক্ত আর একটি উল্লেখযোগ্য গান হল ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়্যা
নিতে চায়’। গানটির কথা ও সুর গণসংগীত শিল্পী আব্দুল লতিফের। গানটি ১৯৫১ সালের
শেষ ভাগে রচিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের জন্য তার রচিত অনেক গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
হল ‘আমি দাম দিয়ে
কিনেছি বাংলার’। এই গানটি এখনও বাংলাদেশে সমাদৃত।
বাংলা ভাষার ও মাতৃভাষার দাবিকে নিয়ে বাংলাদেশে অজস্র গান
রচিত ও সুরারোপিত হয়েছিল। গ্রাম বাংলার পাড়ায় পাড়ায় লোককবি, বাউলরাও তাদের অসংখ্য রচনা ও
পরিবেশনার মধ্যদিয়ে তোলপাড় করে তুলেছিল গ্রাম বাংলার পথ-প্রান্তর। ‘রাষ্ট্রভাষার
আন্দোলনও করিলি রে বাঙালি/ তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাষাইলি’ সে সময়কার একটি কালজয়ী বাংলা গান। গানটির গীতিকার সামসুদ্দিন আহমেদ, সুর করেন আলতাফ মাহমুদ।
মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা দেশ মাতৃকার প্রতি শ্রদ্ধাকে ক্রমে
বাড়িয়ে তুলেছিল। মাতৃভাষাকে রক্ষা করা ও দেশকে
নিজের করে পাবার অধিকারবোধ একাকার হয়েছিল। ভাষা
আন্দোলনের গানের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল,ডি.এল রায় প্রমুখর গানও মুখরিত হয়ে ফিরেছে সেইযুগে। রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘আমার সোনার
বাংলা’ ইত্যাদি গানের সঙ্গে অন্যান্য বহু দেশাত্মবোধক গান
মুখে মুখে ফিরেছে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’, ‘করার
ওই লৌহ কপাট’ ইত্যাদি গান সেযুগে অদ্ভুত প্রেরণা যুগিয়েছে
দেশাত্মবোধে উদ্বেল করে তুলেছে এবং কঠিন লড়াই ও সংগ্রামে প্রেরণা দৃঢ় প্রত্যয় এনে
দিয়েছে ছাত্র-যুবদের।
ভাষা আন্দোলনের সময়ে রচিত গানগুলি একুশের গান নাম পরিচিত। বাহান্ন সালের
পরবর্র্তী কালে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে জাগ্রত করে রাখতে বহু গান রচিত হয়েছে। এইসব গান ভাষার প্রতি মমত্ব তৈরিতে বলিষ্ঠ ভুমিকা
পালন করেছে। আব্দুল জব্বার ফজল এ খোদার কথায়
এবং নিজের সুরে গেয়েছেন ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’,সাবিনা ইয়াসমিন গেয়েছেন ‘মায়ের শেখানো ভাষা’, রফিকুল আলম গেয়েছেন, ‘এক তারেতে সুর বাইন্দা’, শাম্মী আক্তারের গাওয়া ‘বর্ণমালায় গড়েছি দেশ’, ‘বরকত সালামের রক্ত’ ইত্যাদি গান কালজয়ী হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সামিল হয়েছিল সেই ভাষা আন্দোলনে। ২১শের গান বা ভাষা আন্দোলনের গান লক্ষ লক্ষ মানুষকে
ঘর থেকে পথে বের করে আনতে পেরেছিল এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এদেশের সব শিল্পীরাই ভাষার গানের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পেরে গৌরব বোধ
করেছিলেন।
ভাষা আন্দোলন ক্রমে স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিনত হয়। আর তখন থেকেই ভাষা আন্দোলনের গান আর স্বাধীনতা
আন্দোলনের গান মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
মুক্তির গানে দেশ কালের গন্ডি থাকেনা।এপার বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের গান অপার বাংলার
মুক্তি আন্দোলনে তুফান তলে। চেতনাকে শাণিত করতে
দুপারের গানই শাণিত হাতিয়ার হয়ে যায়। মুক্তি আন্দোলনে (গাওয়)
গাওয়া হয় এপারের গণসংগীত ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা', ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি’
ইত্যাদি গান। রবীন্দ্রনাথ ও কাজী
নজরুলের গানও এই আন্দোলনে মিশে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালে। বাংলা নামের ভাষা থেকে
বাংলা নামের একটি নতুন দেশ নতুন পতাকায় পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয়। বাংলাদেশের গৌরবে এপার বাংলার মানুষও গর্ব বোধ করে, বাংলাদেশের এই সংগ্রাম যেন আমাদেরই সংগ্রাম। আর আমাদের
দুঃখ আমরা নিজেদের ভাষাকে সেই মর্যাদা দিতে পারিনি।
স্বাধীনতা
আন্দোলনে বাংলাদেশের জামাত ইসলামী শিবিরে নৃশংস হত্যালীলা চলেছিল। পাকিস্তান সেনা শিবিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা লক্ষাধিক মানুষকে খুন, জখম ও মহিলাদের
ধর্ষণ করেছিল। দেশের মধ্যে থেকে বিজাতীয় মনোভাব নিয়ে এই হত্যালীলা চলেছিল। এর বিরুদ্ধে দেশের অধিকাংশ মানুষ সরব হলেও স্বাধীনতার পরে
৪০ বছর ধরে তাদের বিচার ও শাস্তির কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দেশের বিভিন্ন সরকার নানা সময়ে
এর বিরুদ্ধে কথা বললেও ‘আইন আইনের পথে চলবে’ এই জাতীয় কথা বলে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলছিল। ফলে সাধারণ সব মানুষ ক্রমশ: বুঝতে পেরেছিল যে
কোনো সরকারই জামাত শিবির ও তাদের নেতা রাজাকারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ
করতে চায়না। ফলত: এই শিবির ক্রমে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলে। আধুনিক জনসংযোগ ব্যবস্থার সুবাদে ফেসবুক টুইটার, ইমেল
বিভিন্ন ওয়েব পেজ এর মাধ্যমে সাধারণ সব ধরনের মানুষের মধ্যে সমন্বয় গড়ে ওঠে। তাতেই প্রথম প্রতিবাদের ভাষা
সঞ্চারিত হয়। বিপুল অংশের মানুষের মধ্যে এই সম্মিলন তাদের নতুন পথের সন্ধান দেয়। ফেসবুক টুইটার, ইমেল বিভিন্ন ওয়েব পেজ এর
মাধ্যমে প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবনার সমাবেশ হতে থাকে। অদ্ভুত ব্যঞ্জনায় তা কখনো কাব্যে, গানে কখনো
স্লোগানে ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলাদেশে। (নির্র্দিস্ট) দিন ক্ষণে হাজার থেকে লাখো মানুষের সমাবেশে
গান আর স্লোগানে ভরে ওঠে শাহবাগ চত্বর। শেষ পর্যন্ত সেইসব হত্যা, লুন্ঠন ও ধর্ষনকারীদের ফাঁসির
দাবিতে রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে আন্দোলনের মধ্যদিয়েই গড়ে ওঠে শাহবাগের আন্দোলন
‘গণজাগরণ মঞ্চ’।
এই আন্দোলন
সম্পর্কে কবীর আহমেদ ২৮শে মার্চ ২০১৩ তারিখে লেখেন, ‘গণজাগরণ মঞ্চের (আন্দোলন্সারা) আন্দোলন সারা দেশের মানুষের মধ্যে মুক্তি যুদ্ধের চেতনার
বীজকে আবার উত্থিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর মানুষ সমূহ ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে কন্ঠে তুলে নিয়েছে
‘তুই রাজাকার’ স্লোগান-------যুদ্ধপরাধী কসাই ওরফে কাদের মল্লার যাবজ্জীবন রায়ের
বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম দাঁড়িয়েছিল ঋজু ভঙ্গিমায় প্রতিবাদে শ্লোগানে। পরবর্তিতে এর সাথে যোগ হয়েছে
সারা দেশের মানুষ।-------৫০দিনের আন্দোলনে ৪২ বছরের জঞ্জাল শেষ হবার নয়। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। --------এ সাফল্যের পথ ধরেই আমরা হেঁটে যেতে চাই
অনন্তকাল; রাজাকার মুক্ত আর জামায়াত শিবির মুক্ত বাংলাদেশকে নিয়ে।’[ii]
বাহান্নর
ভাষা আন্দোলনের গান
মুক্তিযুদ্ধের গান নতুন করে
অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করেছে শাহবাগ আন্দোলনে। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলামের গানও প্রেরণা সঞ্চার
করেছে এই আন্দোলনের তরুণ প্রজন্মকে। ‘ঢাকা শহরের
উপকন্ঠে শাহবাগ প্রাঙ্গণে অহোরাত্র মাতৃভাষা প্রেমিকরা জড়ো হয়ে আছেন, তারা
প্রেরণার গান গাইছেন, প্রতিজ্ঞার গান গাইছেন, একটির পর আর একটি কবিতা আবৃত্তি করে
যাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা অথবা নজরুলের, দুই বাংলার ঘরে ঘরে যেসব কবিতা
প্রতিদিন মন্ত্রের মত উচ্চারিত হয় সে সমস্ত কবিতা। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গানের প্লাবনে ভেসে
যাচ্ছে, যারা জড়ো হয়েছেন, হচ্ছেন আগামী দিনেও হবেন তাঁরা অঙ্গীকারবদ্ধ যত
ষড়যন্ত্রই হোক, যত নতুন নতুন বাধা পথ রোধ করে দাঁড়াক না কেন, যে মাতৃভাষার স্বপ্ন বুকে জড়িয়ে তারা
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, জয়লাভ করেছিলেন, গোটা পৃথিবীকে তারা দেখিয়ে দিয়েছিলেন
মাতৃভাষায় কি অমৃতের স্বাদ, সেই ভাষা তাদের জন্মগত অধিকার, কোন দুশমনই ছিনিয়ে নিতে
পারবেনা।’[iii]
অবিভক্ত বাংলায় জাতীয়তাবোধের পাশাপাশি বাঙালির
জাতিসত্বা প্রবল হয়ে উঠেছিল ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের
বিরুদ্ধে। সেসময় যে আন্দোলন দানা বেঁধে ছিল আপামর জনসাধারণ সেই আন্দোলনকে সমর্থন না করে
পারেনি। সে সময় এই
আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তখন গান লিখেছিলেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’
এবং আরো অনেক স্বদেশী গান। নিজে রাখি বন্ধন উত্সব পালন করেছিলেন। ভ্রাতৃত্ববোধের রাখি বন্ধনের পাশাপাশি ‘বাংলার
মাটি বাংলার জল/ বাংলার বায়ু বাংলার ফল/পুণ্য
হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান’ গানটি সমবেতভাবে গাইতে গাইতে
চিত্পুরের রাস্তার দুপাশের পথচারীদের হাতে রাখি পরিয়ে দিয়েছিলেন। হিন্দু মুশলমান সহ অন্যান্য সব
ধর্মের মানুষের হাতে রাখি পরানো হয়েছিল। স্বদেশী গানের স্রোত বয়ে গিয়েছিল সেদিন। এর পরও এই আন্দোলন এবং স্বদেশী
গানের বলিষ্ঠ হুঙ্কার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে পেরেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ঘৃণ্য
ষড়যন্ত্রের যুপকাষ্ঠে বলি হতে হয়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবকে। বাংলার এক অংশ ও পাঞ্জাবের এক অংশ নিয়ে হল
পাকিস্তান। হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা শুরু হল। অজস্র মানুষ ভাতৃঘাতী দাঙ্গায় জড়িয়ে পরল। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হলেন। বাংলার মানুষ স্বাধীনতা পেলনা। নতুন করে পূর্ব বঙ্গের
বাঙালিরা নানাভাবে অত্যাচারিত হতে থাকলেন। জোরকরে উর্দুভাষা চাপিয়ে দিয়ে তাদের মাতৃভাষার চেতনাকে দম
বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করা হতে থাকলো। আবার শুরুহল আন্দোলন। বাংলাভাষায় কথা বলা ও কাজ করার অধিকার রক্ষার দাবিতে। এবারও জয়ী হল বাঙালি, বাংলা
ভাষা। এই আন্দোলনই ক্রমে
স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। বাঙালি জাতিসত্বার পুন:প্রকাশ ঘটল বাংলাদেশের মুক্তি
যুদ্ধের সময়। ১৯৭০-৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচার বেড়ে গেল। বাঙালির গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায়
ভালোবাসি/ চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস ওমা আমার প্রাণে বজায় বাঁশি’; ‘বাংলার মাটি বাংলার জল/ বাংলার বায়ু বাংলার
ফল/পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে
ভগবান’ আবার মুখেমুখে ফিরিতে লাগল। রবীন্দ্রনাথের গান এভাবেই বারে
বারে বাঙালি জাতিসত্বা রক্ষার প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের অবসান হল বাংলাদেশের স্বাধীনতায়।কিন্তু
মুক্তিযুদ্ধের শত সহস্র হত্যাকারীদের সাজা হলনা।৪২
বছর ধরে বিচারের নাম নিরবতায় ধৈর্যের বন্ধ ভাঙল।
ন্যাহ্য বিচারের দাবিতে পথে নামল বাংলাদেশের মানুষ।
শাহবাগ আন্দোলন তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নতুন
প্রজন্ম ভাষা আন্দোলন দেখেনি, দেখেনি মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলন,
হত্যা, ধর্ষণ, নারকীয়তা । তারা পড়েছে ইতিহাস, মুখে মুখে শুনেছে অত্যাচারের
নানান কাহিনী। তাই তারা ফাঁসি চেয়েছে রাজাকার ও তার দোসরদের। তারা গেয়েছে গান কখনো স্লোগান দিয়েছে. স্লোগানের
ভাষা ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই। তুই রাজাকার বাংলা ছাড়.তোমার ঠিকানা আমার ঠিকানা পদ্মা
মেঘনা যমুনা। তুমিকে আমিকে-বাঙালি বাঙালি- জয়বাংলা। শাহবাগের
আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে যোগ দিয়েছে শিল্পীরা। তারাও দিন রাত আন্দোলনের সাথে প্রহর গুনেছে। তাদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে হাজারো গান. আন্দোলনের
প্রেরনায় কত সহস্র গান মুখে মুখে রচিত হয়েছে প্রতিদিন কে তার হিসাব রাখে?
আন্দোলনের প্রাঙ্গণ হয়ে উঠেছে গান ও কবিতা রচনার কেন্দ্রস্থল।
‘শ্লোগানে জেগেছিল, জাগিয়াছে শাহবাগ/বলছে মোদের ধর্মখানা/ধর্ম নাকি ওদেরই জানা/
নিজের মাটি লুটলি নিজেই মীরজাফর/ ধর্ম দোহায় কিকরে হয় যায়েজ তোর/আল্লাহ মোদের
সাথেও থাকে/সবার সকল পথের বাঁকে/ বিচার আবার হবেইরে তোর রোজ হাসর’।
গানটি নীতেশ বড়ুয়ার লেখা। সুর মিশু খান এর । নীতেশ বড়ুয়ার লেখা আরো অনেক গান শাহবাগ
আন্দোলনকে কেন্দ্রকরে প্রকাশিত হয়েছে। শহীদুল্লাহর লেখা একটি জনপ্রিয় গান ‘শাহবাগ
চত্বর /বাঙালি জাতির অন্তর/ এ বিজয় জনতার/ এবিজয়
চেতনার/তারুণ্যের অহংকার’। শিল্পী পুলক দুটি গান রচনা করেছেন। ‘তুই
রাজাকার’ এবং ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’ এই দুটি গান।
জানি হক লিখেছেন, ‘শাহবাগ তুমি’। ব্যান্ডের
গান ও শাহবাগ চত্বরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার ছিঁড়া
ব্যান্ডের দল গেয়েছে-
‘আমি দেখেছি দুই শুন্য তেরো
দেখিনি একাত্তর
দেখেছি শাহবাগ জনসমুদ্দুর।
আমাকে আজও মিছিল টানে
জয় বাংলা স্লোগানে
একসাথে বাঁচি একসাথে লড়ি
একসাথে এসো গিটার ধরি
দাবিদাওয়া শুধু ফাঁসির দড়ি’।
একটি গানের দল ‘সার্কেল’ গেয়েছে,-
‘খুব ভোরে
এসেছি এখানে
জনস্রোতে হারায় এক হয়ে
নতুন সূর্যটাকে দেখব বলে, নতুন করে
আজ এখানে মিশে যাই এক শরীরে।
তোমার দেওয়া কথা রাখব বলে
আমার চিত্কার বাতাসে মিশে
বধির তুমি, শুনতেকি
পাও তা,
পুরানো স্বপ্নকে নতুন করে সাজাই
আমরা ক’জনা’।
শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনকে ঘিরে কতযে গান রচনা হয়েছে তার হিসাব নেই।
অনেকে গান গেয়ে ফেস বুকে, ইউটিউবে আপলোড
করেছে। সেসব গান শুনেছে হাজারো,লাখো
মানুষ।গানগুলির শৈল্পিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও কোনো ঘাটতি নেই, সাহিত্য
গুনও যথেষ্ট উন্নত।এসম্পর্কে সূর্যসারথী নামে একজন লিখেছেন,
‘মায়ের
ছেলেরা আজো যাইনিতো মরে
আগামী ফোটাব সূর্য সাজানো ভোরে।
ভাই হত্যার প্রতিশোধে দৃঢ় প্রত্যয় আজ
বুকে বেঁধেছি দৃপ্তপ্রাণ
আর মাথায় মরণ তাজ’।
গানটির কথায় ও সুরে যে বলিষ্ঠ প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছিল সেটাই ছিল শাহবাগের শপথ। শাহবাগ
সারা পৃথিবীর কাছেই ঘোষণা করেছে নরঘাতক আর মৌলবাদ শেষ কথা নয়। শেষ
কথা হবে মানুষ। এই শ্লোগান আর গান শাহবাগ চত্বর থেকে
বাংলাদেশের মাঠ ময়দান কারখানায়, কলে ধ্বনিত
হয়েছে ২০১৩র ফেব্রুয়ারিতে।
বাংলাদেশের
আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সারা পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের বাঙালিরা সরব হয়েছে। গান লিখেছে তারাও। ফেসবুকে, ইউটিউবে
আপলোড করে নিজেদের
গান পৌঁছে দিয়েছে ঘরে ঘরে। এপার বাংলার কবির সুমন
বেশ কিছু গান রচনা করেছেন। তাঁর কথায় ও সুরে একটি গান-
বিমানে উড়তে তিরিশ মিনিট
এত কাছে তবু দূর
বিলকূল নেই পাশপোর্ট ভিসা
সীমানা চেনেনা সুর।
সীমানা চিনিনা আছি শাহবাগে
আমার গিটারও আছে
বসন্ত আজ বন্ধুরা দেখো
গান দাবি হয়ে বাঁচে।
কবীর সুমনের গানের মধ্যদিয়ে শাহবাগের পঞ্চম দিনের আন্দোলন শুরুহয়। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম লিখেছে, “শনিবার সকালেই
আন্দোলনের শুরুতেই সুমনের গান বেজে ওঠে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাইকে। ভারতীয় বাঙালি গায়ক ও
গীতিকার কবীর সুমনের সে (দেষে) দেশে বসেই লেখা গানটি শুনেই উদ্দীপ্ত হন সমবেত মানুষেরা।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেশের
মানুশের পাশাপাশি গানের সুরে (সঙ্ঘতি) সংহতি জানিয়ে সুমন গানটি লিখে ও সুরারোপ করে পাঠান
শুক্রবার। এরপর থেকে ‘সীমানা চেনেনা সুর গানটি অলিখিতভাবে (গনয়ান্দোলনের) গণ আন্দোলনের থিম সং এ পরিণত হয়েছে। গানে গানে
সুমনের সংহতি প্রমান করে সত্যিই ‘সীমানা চেনেনা সুর’। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে অনুভুত হয়
সুমন ও তার গিটারের অস্তিত্ব”।[iv]
বাংলাদেশের তরুণ সংগীত শিল্পী প্রীতম আহমেদ এর অনেক গান শাহবাগ আন্দোলনে
বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক গানটি আন্দোলনের চতুর্থ
দিনে আন্দোলনের শুরুতে জাতীয় সংগীতের পরেই গাওয়া হয়। গানটি আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে নতুন
মাত্রা যোগ করে বলে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা হয়। প্রীতমের গাওয়া জনপ্রিয় অন্যতম
গান ‘শাহবাগ কলিং আবার একাত্তর’ শাহবাগের লাখো জনতাকে উজ্জীবিত করেছে। তার প্রতিটি
গানই জয় করেছে মুক্তিযুদ্ধের মানসিকতাকে।
প্রীতমের আর একটি গান ‘আমার ধর্মটাও তোমার কাছে জিম্মি হয়ে গেলো’ মৌলবাদের
হিংস্রতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়েছে। সব ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিভেদের ও বৈষম্যের
অন্যায় প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কালজয়ী গান লিখেছেন প্রীতম। এই গান বাঙালির
অহংকার। লালনের ভাষা যেন নতুন করে
নতুন ব্যঞ্জনায় নতুন সুরে জেগে উঠেছে প্রীতমের কন্ঠে। মৌলবাদের হিংস্রতার বিরুদ্ধে
তীব্র ধিক্কার ধ্বনিত হয়েছে এই গানে।
শাহবাগের আন্দোলন শুধু রাজাকারের ফাঁসির দাবিতেই নয়, সেখানে নতুন করে
জেগে উঠেছে মাতৃভাষার প্রকৃত অধিকারের দাবি, মুক্তি আন্দোলনের সুর, ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি, সর্বোপরি সত্য ও
মানবতার অধিকারের দাবি। শাহবাগ পথ দেখায়, শাহবাগ দৃষ্টিকে সুন্দর করে , শাহবাগ দূরকে কাছে টানে, শাহবাগ একসঙ্গে
পথ চলার শপথে বলীয়ান। ধর্মনিরপেক্ষ, স্বাধীন সার্বভৌম নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার দাবি উঠেছে।
মুক্তি আন্দোলনে হত্যাকারী, লুন্ঠনকারী
ও
ধর্ষকদের ফাঁসির আর তাদের মদতদাতাদের দলকে বে-আইনী ঘোষনার দাবি উঠেছে সারা
বাংলাদেশ জুড়ে। আর শাহবাগ স্কোয়ারে আন্দোলন তারই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ।
১৯৫২ সালে ও তার পরে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকে ঘিরে অজস্র গান রচিত ও গীত
হয়েছে ১৯১৩ সালের শাহবাগের গান নতুন করে সেই আবেগকে জাগিয়ে তুলেছে। ভাষা আন্দোলনের
প্রেরণাকে স্মরণ করিয়ে দুই বাংলার আত্মিকতাকে আরো জাগিয়ে তুলেছে। কোথাও
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ সুকান্ত, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, আব্দুল গফফর চৌধুরী, প্রীতম আহমেদ, কবীর সুমন সবার
মুক্তির গান, শিকল ভাঙ্গার গান, বাংলার গান, বাংলা ভাষা ও মাতৃভাষার গান ও মানবতার গানে যে চেতনা তা জাতীয় থেকে
আন্তর্জাতিকতায় উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র, শোষনের বিরুদ্ধে
সেই আন্দোলন না হলেও মানবতা দিয়ে যার সূচনা ও বিস্তার তা একদিন পৃথিবীর সব
অন্যায়ের বিরুদ্ধে গান গাইবে। বিশ্বের সব প্রান্তের সঙ্গে মিলবে দুই বাংলার
মানুষের সুর এই আশ্বাস আমরা পেয়েছি ওপার বাংলার শাহবাগের আন্দোলনে।
[ii] কবীর আহমেদ।শাহবাগ চত্বর . 21 August 2013. www.amarblog.com/category September 21,
2013
অ্যাক্সেস
হয়েছে
No comments:
Post a Comment