বিশ্বায়নের সঙ্গে ভারত
অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বিংশ শতকে ১৯৯১ সালে। আটের দশক থেকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং তা বজায় রাখার
ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থাগুলো উঠে পড়ে লেগেছিল। তারই ফলশ্রুতিতে অনেকটা চাপে পড়ে ভারতকে বিশ্বয়ানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে
হয়েছে। মূলতঃ ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলো নিজেদের কতৃত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে এবং
নিজেদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট
থেকে মুক্তির জন্য তৃতীয় বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোর বাজারকে দখল করার উদ্দেশ্যে সফল
হয়েছে বিশ্বায়নের মধ্যদিয়ে। বিশ্বায়নের
চুক্তির সময় ছোট ছোট ও মাঝারি শিল্পের
মালিকরা ভয় পেয়েছিল নিজেদের অস্তিত্বের কথা ভেবে। এতদ সত্বেও কেউ কেউ বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার
মধ্যে সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন ‘..তাই আমরা মনে করছি : বিশ্বায়নকে
ঘিরে গত পৃথিবীর কম উন্নত দেশগুলোর সামনে যতোনা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক,রাজনৈতিক
এবং সামাজিক তারথেকে বেশি বড় বিপদ মানুষের চিন্তা-চেতনাগত দীনতায়. মানুষের জে
প্রতিবাদী কন্ঠস্বর, যে প্রতিবাদী মনন সমাজ বিকাশের ধারা সুনিশ্চিত করেছে, তা যদি
ভোতা হয়ে যায় তা হলে মানব জাতির সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ সূচিত করে.’ (কর ২০০৩) [i]
বিপদ কিন্তু বিশ্বায়ন
কার্যকর হওয়ার পরথেকেই নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে বহু ছোট ও মাঝারি শিল্প ও বাণিজ্য
ব্যবস্থা। অন্যদিকে শিল্পোন্নত
দেশগুলোর এবং আমাদের দেশের বেশ কিছু বৃহত শিল্পের মালিক নিজেদের মুনাফাকে বহুগুন
বাড়িয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন আর্থিক সমীক্ষা থেকে জানাযায় যে, গত তিরিশ চল্লিশ বাছারে তাদের মুনাফা বেড়েছে
বহুগুন।
ভারতের সঙ্গে বিশ্বের
বিভিন্ন দেশের বানিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেনের সম্পক বহু বছর ধরে গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন দেশের মানুষ ভারতে
আসছে খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকেই। আড়াই হাজার বছর আগে ভারতে এসে ছিল আর্যরা। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার জন্য বৌদ্ধ ভিক্ষুরা খ্রিস্ট
পূর্বাব্দে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বৌদ্ধ ধর্মের টানেই চীনা পরিব্রাজক ফা হিয়েন ও
হিউয়েন সাং ভারতে এসেছিলেন। খ্রিস্ট পূর্ব
তৃতীয় শতকে ভারত থেকে বাণিজ্য হত ব্রহ্মদেশে, মালয়েশিয়াই ও কাম্পুচিয়ায়। খ্রিস্টপূর্বাব্দে
আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় থেকেই
ভারতের সঙ্গে পশ্চিমের দেশগুলির সংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রোমের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দৃঢ় হয় । সে সময় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে
সম্পর্কের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। বিভিন্ন দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয়দের
পরিচয়ও গড়ে ওঠে এবং সংস্কৃতির আদান প্রদান
হয়। ধর্ম প্রচার,ব্যবসা
বানিজ্যের সুবাদে কিংবা দেশ জয় করার সময় মানুষের এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাতায়াত
করতে হয়েছে। এভাবেই বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার বিনিময় হয়েছে। যুদ্ধে
ও অভিযানে বহু বিপদ এসেছে বহু রক্তক্ষয়
হয়েছে। জীবন হানি হয়েছে। কিন্তু তা
সত্বেও অনেক সময় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে দেখা গেছে। দেখাগেছে পৃথিবীর প্রায় সব বড় আন্দোলনেই
সংস্কৃতি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। ইংরেজদের সময়ে বিশ্বায়নের গতি দ্রুততার সঙ্গে এগিয়েছে, যদিও
এই বাণিজ্য ব্যবস্থাকে বিশ্বায়ন বলা হয়নি. পল সুইজি মান্থলি রিভিউ পত্রিকায়
লিখেছিলেন, ‘বিশ্বায়ন কোন শর্ত নয়.ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন ঘটনা নয়, এ হচ্ছে একটি
প্রক্রিয়া. বহুদিন ধরে চলছে এই প্রক্রিয়া. সেটা প্রায় চার পাঁচশো বছর ধরে. তবে
পুঁজিবাদের ভেতরে এমন ব্যবস্থা রয়েছে যে তা সবসময় ছড়াচ্ছে বা সম্প্রসারিত হচ্ছে. এ
সম্প্রসারণ ঘটে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরে ও বাইরে.’ [ii]
বিংশ শতকে বিশ্বায়ন এমন
একটা পদ্ধতি যার সাহায্যে জ্ঞান ও চেতনার বিস্তৃতি ঘটে চলেছে এবং পণ্যের বিনিময়
ব্যবস্থার প্রকাশ ঘটে চলেছে। এর আগে যা ছিল
খুবই সীমাবদ্ধ, নিয়ন্ত্রিত, তা এই ব্যবস্থায় ব্যাপ্ত হল। গন্ডি গেল বেড়ে। বাধাধরা নিয়মে শৈথিল্য আনা হল। কিন্তু বাঁধন ঘুচলনা। ক্ষুদ্রের উপর বৃহতের কতৃত্ব বাড়ল। তাসত্বেও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে
বিধিবদ্ধ চেতনার মুক্তি ঘটল। জাতীয়তাবোধের থেকে ক্রমে
যাত্রা শুরু করল অন্তার্জাতিকাতাবোধের দিকে। ইউরোপের সঙ্গে সারা
পৃথিবীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল অনেক আগে থেকেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে
শিল্প বাণিজ্য ও সংস্কৃতির সম্পর্ক ছিল বাধ ধারা নিয়মে সীমাবদ্ধ। বিশ্বায়নের ফলে সেই সম্পর্ক আরো বেশি গভীর হল। বিদেশ থেকে আরো বেশি করে শিল্প
সংস্কৃতির উপকরণ, বৈদ্যুতিন বাদ্যযন্ত্র আসতে শুরু করল। সহজ লভ্য হল বিদেশী অন্যান্য পণ্যও। বিশ্বায়নের আগে
থেকেই বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। ইউরোপ
আমেরিকা, চীন, জাপান প্রভৃতি উন্নত দেশগুলো তাদের উত্পাদিত পণ্যের বাজার পাচ্ছিলনা। বিশ্বায়নের ফলে তারা বাজার পেল। রপ্তানির দরজা গেল খুলে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর বাজারে ছড়িয়ে পড়ল
তারা তাদের সব রকমের পাশরা নিয়ে। কত হাজার রকমের খেলনা, রকমারি খেলার পুতুল, গান
গাওয়া গাড়ি,সুর তোলা রং বাহারি মন কাড়া চমকের আমদানি হল। বিদেশি
পণ্য বলে মুখ ফিরিয়ে নেবার কোন বলিষ্ঠতা আর রইলনা। নতুন
মোড়কে উপনিবেশবাদের ছায়ায় আমাদের সংস্কৃতির
চর্চা বেড়ে চলল। তাই সমাজ বিজ্ঞানী সুমিত কর লিখেছেন, ‘বিশ্বায়নের আগ্রাসন
কেবল মাত্র অর্থনীতির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই, বিশ্বায়নের থাবায় আক্রান্ত মানুষের
সাংস্কৃতিক চেতনাও. বিশ্বায়ন সংস্কৃতিকে পরিণত করেছে এক বিশাল মুনাফা অর্জনকারী
শিল্পে.অর্থনৈতিক উদারনীতি এবং বিশ্বায়নের যৌথ
আধিপত্যের কারণে অন্যান্য দেশের মতই আমাদের দেশেও এক ভোগবাদ প্রবণ সংস্কৃতি
বা পণ্য সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, দেখা দিয়েছে এক মারাত্মক কমোডিটি ফেটিশিজিম’. (কর ২০০৩)
পাশ্চাত্যের ইলেকট্রনিক্স
বাদ্যযন্ত্র, সিন্থেসাইজার, অক্টোপ্যাড, ইলেকট্রনিক্স পিয়ানো, হ্যান্ডসনিক,
ইত্যাদি সাহজ লভ্য হল আমাদের বাজারগুলোতে। বাহু বাড়িতে এইসব যন্ত্র শোভা পেতে থাকল। আবার অনেকে বাজানোর জন্যও কিনলেন। কাঠোর
অধ্যাবসায় নিয়ে এসব শেখা শুরু হল। পাশ্চাত্য সংগীত ও বাদ্যযন্ত্র শেখানোর স্কুলগুলোতে ভীড় বাড়তে থাকল। স্পানিশ,সিন্থেসাইজার, অক্টোপ্যাড,
ইলেকট্রনিক্স পিয়ানো,ব্যাঞ্জো, ট্রামপেট, ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ক্রমে প্রাধান্য
বিস্তার করতে লাগল।
মধ্যযুগে
প্রবন্ধ গান ও পারস্য বা সুফি গানের সংমিশ্রনে যেসব গান বিকশিত হয়েছিল, আধুনিক যুগে তা আরো নতুন রূপে বিকশিত হল। প্রাচীন
যুগের গানে বাদ্যযন্ত্রের অনুসংগ ছিল সমান
ভাবে।মধ্য যুগে বিভিন্ন নতুন গীত রীতির বিকশিত রূপ লক্ষ্য করা গেল। কিন্তু বাদ্যযন্ত্র সন্নিবেশের মধ্যে কোন নতুনত্ব বা পরিবর্তন দেখা
গেলনা। নতুন বাদ্যযন্ত্রও এল পাঠান মুঘলদের মাধ্যমে। ক্রমে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন বাদ্যযন্ত্র
রূপ পেল। আধুনিক যুগে গানের অনুসংগ বাদ্যযন্ত্র ক্রমে স্বতন্ত্রভাবেও বাদিত হতে
থাকল। স্বতন্ত্র বাদন ধারার বিকাশ হল। গানের ধারার সংগে বীণায় বাজল ধ্রুপদাঙ্গের
সুর আর সেতার, বেহালা, বাঁশিতে বাজল খেয়াল আঙ্গীক সুর। প্রতিটি বাদ্যযন্ত্রের
স্বতন্ত্রধারা স্বীকৃতি পেল। পাশ্চাত্যের শিক্ষা
আমাদের এককভাবে চলার শিক্ষা দিয়েছে। বিশ্বায়নের সুর আমাদের নানাভাবে অনুপ্রাণীত
করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গান ও সুরধারা বহুকাল ধরেই আমাদের মধ্যে চলে
এসেছে। আমরা তার ভাল মন্দ সবই দেখেছি, শুনেছি, বুঝেছি। অনেক অন্ধকার আমাদের
দিকভ্রান্ত করে দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যের
আলো যখনই উদ্ভাসিত হয় আমরা আমাদের পথ খুঁজে পাই।সত্য ও সুন্দরকে চিনে নিতে আমাদের কোন অসুবিধা
হয়না।আর তাই ভারতীয় সুরধারা নিজের গরিমায় সমুজ্জ্বল
রয়েছে চিরকাল।
আধুনিক যুগে পাশ্চাত্য
শিক্ষা ও চেতনায় ভারতীয়
সংগীতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের চিন্তা চেতনা যত উন্নত হয়েছে ততই আমাদের
জ্ঞান ও সূক্ষ্মতার প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে। সঙ্গীতের স্বরূপকে নিয়ে বিশ্লেষণ
হয়েছে। বিশ্লেষণ হয়েছে মন ও চেতনার সঙ্গে সঙ্গীতের
সম্পর্কের দিকটিও।সঙ্গীত এত ভালো
লাগে কেন এই তত্বটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক। প্রাচীন কালে শিল্পের রাসা সৃষ্টি নিয়ে ভ্হারাত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে আলোচনা
করেছেন।পাশ্চাত্যের সুবিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো এবং
এরিস্টটলের আলোচনার সঙ্গে ভারতের আলোচনার বেশ মিল রয়েছে। আধুনিক যুগে সৌন্দর্যবোধ নিয়ে চিন্তা ভাবনা
বেড়েছে অনেক। পাশ্চাত্যের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী,
দার্শনিকদের বিভিন্ন ভাবনার পাশাপাশি ভাড়াটিয়া দর্শনকে নতুন করে যুক্তি ও তত্বের
সাহায্যে প্রতিস্থ করা এবং নতুন মৌলিক ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে নতুন নতুন তত্ত্ব
প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।ভাড়াটিয়া রাগ
সঙ্গীত ও অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ভারতের রসতত্ত্ব ও অনুকরণ তত্ত্ব। বিভাব অনুভাব ও সঞ্চারী ভাবের সাহায্যে তিনি
নাটকে রস সৃষ্টির কথা বলেছেনজ যা অন্যান্য শিল্পের সঙ্গেও সম্পর্কিত।অন্যদিকে ভারতের কথায় ‘লোকানুবৃত্বানুকরণম’ এর মধ্য দিয়ে শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনুকরণের উপর জোর
দিতে চেয়েছেন। যাই হোক ভরতের
পর দীর্ঘকাল শিল্পের সৌন্দর্য সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত
আলোচনা হয়নি। আধুনিক যুগে পাশ্চাত্য চেতনায় উন্নীত হয়ে নানা
আলোচনা করেছেন ভারতীয় আলোচকরা। ভারতীয় দর্শনের
সত্যম, শিবম, সুন্দরম কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা সত্য তাই সুন্দর ও কল্যানকর বলে।যার সঙ্গে কিটস এর truth is
beauty, beauty is truth এর সাযুজ্য দেখতে পাই। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের শিল্প সম্পর্কে অনেক
বক্তব্যে আধুনিক চিন্তার বহু উপাদান পাই।আসলে আধুনিক যুগ হল সত্য অন্বেষনের ও বিজ্ঞান চেতনার অগ্রগতির যুগ। পুরাতনের মধ্যে যে ঐতিহ্য ও সৌন্দ্যর্য্য তার
কারণ অনুসন্ধান ও তাকে আবিস্কার করার ক্ষেত্রে এই যুগ অনেকটা এগিয়ে এসেছে।
আধুনিকযুগে সংগীতের বিকাশের
ক্ষেত্রে বহু নতুন রূপ যেমন লক্ষ্য করা গেছে, তেমনি ভারতীয় সংগীত দিন দিন
সর্বত্রগামী হচ্ছে। শিল্পের উন্নতি বিশেষ করে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের
বিকাশ ও তা যত বেশি করে সাধারণ মানুষের আয়াত্বাধীন
হচ্ছে ততই ভারতীয় সংগীতের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা পল্লবিত হয়ে দেশের প্রত্যন্ত
অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌছে যাচ্ছে। মধ্যযুগে
সম্রাট, রাজা ও জমিদারদেরদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় রাগ সঙ্গীত উন্নততর জায়গায় পৌছে
ছিল।কিন্তু তা সীমাবদ্ধ ছিল নির্দিষ্ট কিছু মানুষের
মধ্যে। আধুনিক যুগে পাশ্চাত্যের নবজাগরণের ছোয়া লাগে
ভারতে। ভারতের গণতন্ত্র বিকশিত হয়। বিজ্ঞান চেতনাও জাগ্রত হয়। এতদিন যেসব সঙ্গীত দরবারেই সীমাবদ্ধ ছিল ক্রমে
তা সাধারনের কাছেও পৌছাতে সক্ষম হয়। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান চর্চার ফসল ভারতেও আসতে
শুরু করে। ১৯৩০ সালে National Public Radio
Broadcaster of India এবং
তার পরবর্তীকালে আকাশবাণীর মাধ্যমে প্রত্যন্ত্য অঞ্চলেও উন্নততর সব ধরনের সঙ্গীত পৌছে যায়। সকলেই সংগীতের এক স্ট্যান্ডার্ড রূপকে বুঝতে
পারে। রেডিওকে কেন্দ্র করে ভারতে গানের জগত বৃহত
শিল্পে পরিণত হয়। রেডিও নির্মান
শিল্প, বেতার কেন্দ্র পরিচালনা, রেডিওর বিক্রি-বাণিজ্য ইত্যাদির জন্য বহু মানুষ নিযুক্ত হয়। রেডিওর মাধ্যমে সঙ্গীত চতুর্দিকে ছাড়িয়ে পড়ার ফলে
আঞ্চলিক ক্ষেত্রে, রাজ্যে এবং সারাদেশের সঙ্গীতের মধ্যেই এক উন্নততর রূপ সর্বত্র
মোটামুটিভাবে একই রকমে অনুসৃত হতে থাকে। নতুন করে প্রাণ পায় ভারতীয় সঙ্গীত।সংগীত শিক্ষা ও চর্চার ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
১৮৯৮ সালে কলকাতায় আসে
গ্রামোফোন। গ্রামোফোনের
মাধ্যমে আরো সহজ হয় গানকে ধরে রাখার। গানকে বারবার
শোনার মাধ্যমে গান শেখা আরো সহজ হয়ে ওঠে। একসঙ্গে অনেক মানুষ গান শুনতে ও শিখতে পারে। গানকে সংরক্ষণ করাযায়। ফলে গানের জগতে এক যুগান্তকারী অবস্থার সৃষ্টি
হয়। গান শোনার ও শেখার আগ্রহ আরো বাড়ে। গানের রেকর্ড নির্মান, রেকর্ড বিক্রি, গ্রামোফোন
নির্মাণ ও বিক্রির এক বিশাল বাজার তৈরি হয়। বহু মানুষ প্রত্যক্ষ্যভাবে এইসব কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।এভাবেই বিকশিত বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে রাগ
সঙ্গীত সহ সব ধরনের সংগীত ও চারুকলার প্রকাশ ঘটতে থাকল। সে সময় থেকেই বিশ্বায়নের শুরু বলা চলে। যদিও তখন বিশ্বায়ন শব্দের ব্যবহার শুরু হয়নি। ইউরোপের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর সঙ্গে সেসময় থেকেই ভারতের যোগসুত্র
তৈরি হয়। যুগে যুগে এমন অনেক খারাপ অবস্থার মধ্যেও
নতুনকে খুঁজে পেয়েথাকি, আর ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার মধ্যে আমরা পেলাম আধুনিক, উন্নত ও
বিজ্ঞান মনস্ক চিন্তা চেতনাকে। পেলাম নবতর
সঙ্গীত ও সঙ্গীত প্রকাশের নানা মাধ্যম।উচ্চাঙ্গ সংগীতের নানা নতুন ধারার বিকাশ ঘটেছে এই সময়ে। এছাড়া পাশ্চাত্য সুরের সংমিশ্রণে নানা নতুন
ধারার গান রূপ লাভ করলো।
বিশ্বানের এই ক’বছরেই ভারতে
ও ভারতের পাশপাশি দেশগুলোতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংগীতের প্রভাব আরো প্রকট ভাবে
লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্বায়নের ফলে
মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা ক্রমশঃ বাড়ছে। তথ্য-প্রযুক্তি সারা পৃথিবীর বাজার ছেয়ে ফেলেছে। টিভি, কম্পিউটার, আইপড, আইপ্যাড, হাতে হাতে
মোবাইল আর তাতে মিনি কম্পিউটার। দেশ বিদেশের
উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন আজ খুব কম দামে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা পৃথিবীও ধরা দিয়েছে
ওই সব তথ্য মাধ্যমে। মধ্যযুগের অধরা
গান চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। ইউ টিউবে,
ফেসবুকে গানের আপলোড ডাউনলোড চলছে অনর্গল। গান বাজনা নিয়ে অনর্গল পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। চলছে মেলানো মেশানোর নানা চেষ্টা। তাতে ভালো মন্দ দুই হচ্ছে। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ‘জীবনমুখী গানে’র সুত্রে
নতুন নতুন গানের বিকাশ ঘটেছে। এসেছে
‘ব্যান্ডের গান’ নামের সমবেত সঙ্গীত, ‘ফিউশন মিউজিক’। রেকর্ডিংয়ের দুনিয়া গেছে বদলে। উপযুক্ত সফটওয়ার সহ একটা কম্পিউটার, কয়েকটা
মাইক্রোফোন আর হেডফোন নিয়ে ঘরে ঘরে ষ্টুডিও চলছে। প্রতিদিন হাজার হাজার গান আর সুর রেকর্ডিং হয়ে
বাজারে বেরোচ্ছে। ইউ টিউবে,
ফেসবুকে গানের আপলোড ডাউনলোড চলছে। সমস্যা হচ্ছে
এর মধ্যে ভালো মন্দ সব মাইল মিশে একাকার। গানের জঙ্গল তৈরি হয়েছে। ঐতিহ্য ও
মূল্যবোধের জায়গায় স্থান পাচ্ছে নীতিহীন চমক। জেল্লা চটকদারিত্বের অহংকার বেশি করে লক্ষ্য
করা যাচ্ছে। লক্ষ্য ও আদর্শহীন এক অদ্ভুত পরিবেশ রচিত হয়েছে। নীতি ও নৈতিকতার পরিবর্তে অর্থহীন অশালীনতা,
ঔধত্ব সমাজকে ঘিরে ধরেছে। বিক্রিত তথ্য় ক্রমাগত দিশাহীন করে দিচ্ছে
দেশ–কাল-সমাজকে। তার প্রভাবও পড়ছে সংগীতে। তবু
‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে’। এই সত্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া শিল্পী
সমাজের কিইবা করার আছে?
বিশ্বায়নের মূল লক্ষ্য
বাজার। সেখানে নীতি, আদর্শ স্থান পায়না। মানবিকতার কোনো গুরুত্ব নেই। ফলে মুল্যবোধ হীন
যান্ত্রিকতা স্থান পেয়ে যায় সহজেই। ভালো মোড়কে অত্যন্ত নগন্য উপকরণও জায়গা করে নেই। উচ্চ মানের গান জায়গা পায়না কিন্তু ‘টুনির মা’ বানিজ্যিক সাফল্য পায় তখন আমরা সমাজের দৈন্যকে
স্পষ্ট দেখতে পাই। বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় পৃথিবীর সব কিছুই পণ্য। মানবিকতার সম্পর্ক, ঐতিহ্য়, কৃষ্টি, শিক্ষা,
সংস্কৃতি,সব কিছুই অর্থমূল্যে বিচার হয়। ভারতীয় শিল্প সংস্কৃতির বিচার হয় অর্থ মূল্যে। আর তা
নির্ভার করে তার প্রচার,বিজ্ঞাপন ও মোড়কের উপর। আমাদের দেশ সে
দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে বলেই মনে হয়। অন্যদিকে চীন,
জাপান, আমেরিকা আমাদের দেশের গান আর সুর যুক্ত করে নিজেদের দেশে পুতুল, গাড়ি
ইত্যাদি খেলনা তৈরি করে আমাদের দেশেই অবাধে বিক্রি করছে। আমরাও
কমদামে জিনিস পেয়ে আমরাও খুশি। অনেকে বলছেন খুব
ভালো হয়েছে। বাড়ির কাছেই বিগবাজার। একসাথে
পৃথিবীর সব কিছু কেনাযায়। আর আমরা বালি আমাদের দেশের টাকা চলে যাচ্ছে
বিদেশে, আর আমরা বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছি। তার
ভায়াবহ প্রভাব পড়ছে ভারতীয় অর্থনীতিতে, সমাজব্যবস্থায়।
আমাদের দেশের সংগীত মেধাও
বিকিয়ে যাচ্ছে বিদেশে। গুনী শিল্পীরা দেশে দাম না পেয়ে চলে যাচ্ছে
আমেরিকায়, ইউরোপে। সেখানে তাদের মেধাকে ব্যবহার করে চলছে স্কুল
কলেজ। ভবিষ্যতে আমাদের সুরকে ব্যবহার করে নানা
সাংগীতিক উপকরণ তৈরি করে আমাদের কাছেই ওরা বিক্রি করবে, আমাদের সুরের পেটেন্ট নেবে
ওরা। আর আমরা ওদের সুর নকল করতে করতে ক্রমে আমাদের
দেশের সংগীত ও সংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলব এরকম ভয়ও করছেন অনেকেই ।
কর, শমিত. “বিশ্বায়নের হল হকিকত.” In বিশ্বায়নের হল হকিকত, by শমিত কর,
১৩১ . কলকাতা: ডিরেক্টেড ইনিশিয়েটিভ, ২০০৩.
No comments:
Post a Comment